পাতা:প্রবাসী (ষড়বিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৪৫২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৩য় সংখ্যn ) জন্মদিনে 8>☾ দেবতাকে । মাটি যেমন ক’বে ভক্তের ভক্তিকে গ্রহণ করে, আমিও তেমনি ক’রেই আপনাদের শ্রদ্ধা-নৈবেদ্য গ্রহণ কবি। তাই সঙ্কোচ পরিহার ক’রে এখানে এসেছি। আনন্দের শঙ্খধ্বনি মানুষের জন্মকালে বেজে ওঠে । প্রত্যেক জন্মের মধ্যে আনন্দময় একটি মহৎ প্রত্যাশা আছে। মানুষের চিরকালের যে আকাঙ্ক্ষা তাই পূর্ণ হবে, যুগযুগাস্তের এই প্রত্যাশা বারে বারে নবজাত শিশু বহন ক’রে আনে ; আমাদের ভিতর যা কিছু অসম্পূর্ণ তাই সম্পূর্ণ হবে, এই সম্ভাব্যতা তার মধ্যে আছে। কিন্তু আজ আমার জন্মদিন তেমন নূতন জন্মদিন নয়, নূতন প্রত্যাশা জাগাবার সম্ভাবনা তার আর নেই। আমার কৰ্ম্ম প্রায় শেষ হ’য়ে গেছে। যদি কোনও আনন্দ দিয়ে থাকি, কোনও সা স্বনা এনে থাকি, তবে সে দেওয়া হ’য়ে গেছে, সামনে আর কিছু নেই। কিন্তু তবু মন ত বলে না, সকল প্রত্যাশার প্রান্তে এসেচি। এখন কি কেবলই পুরাতন, অভ্যাসের দ্বারা বাধা, সংস্কারের দ্বারা কঠিন, নিত্য ব্যবহারের দ্বারা অসাড় ? এখনে জীবনে অভাবনীয় কি কিছু নেই ? তা তো বলতে পারিনে। অজানার ডাকে এখনো প্রাণ সাড়া দেয়, নূতনের ভাষা এখনো বুঝতে পারি। বিশ্বমানুষ বারে বারে যেমন শিশু হ’য়ে জন্মায়, তেমনি প্রত্যেক মানুষ বারে বারে শিশু হ’য়ে না জন্মালে বিশ্বের দেওয়া নেওয়া তার কাছে স্তব্ধ হ’য়ে যায়। বরিস্কার সীমাভাঙার দ্বারা, আপনার মধ্যে যে অসীম আছে তাকে পাই। প্রাচীন বয়সের দুর্গের পাযাণ ভিত্তির মাঝখানে আজি যে বাসা বেঁধেছে, সে আমি কেউ নয়।—আমি কবি, একটি পরম সম্পদ বহন ক’রে এনেছিলুম। কি আনন্দ ছিল, আমার সঙ্গে আমার চারিদিকের যোগে । আমার সেই ঘরের সামনে নারিকেল বৃক্ষের শ্রেণী, শরতের আলোতে তার পল্লবের ঝালর ঝলোমলো ; শিশিরসিক্ত তৃণাগ্রগুলির পরে প্রভাতসূর্য্যের কিরণ বীণা তন্ত্রীতে স্বরবালকের আঙ্গুলের স্পন্দনের মতো। এই খামলা ধরণী, এই নদী, প্রান্তর, অরণ্যের মধ্যে আমার বিধাতা আমাকে অন্তরঙ্গতার অধিকার দিয়েছেন, এর মধ্যে নগ্ন শিশু হ’য়ে এসেছিলুম। আজও যখন দৈবীবীণা অনাহত স্বরে আকাশে বাজে, তখন সেদিনকার সেই শিশু জেগে ওঠে, শিশু জেগে উঠে বলতে চায় কিছু, সব কথা ব’লে উঠতে পারে না। আজ আমার জন্মদিন সেই কবির জন্মদিন, প্রবণের না। আমি কিছু কৰ্ম্ম করেছি, সেবা করেছি, কিছু ত্যাগ করেছি –কিন্তু সে বড় কিছু নয় । সকলের চেয়ে যে বড় দান, সে আপনিই আপনাকে দেয় ; পুষ্পের গন্ধ প্রকাশ পেলে বাতাস ভরে ওঠে ; সে গন্ধ ফুলের অন্তর থেকে আপনি প্রবাহিত । ভাণ্ডার থেকে তাকে চাবি খুলে আনতে হয় না। সে তার সত্তার সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন। সেই রকমের সত্যদান যদি আমার কিছু থাকে, আনন্দলোকে যার সহজ অনুভূতি, যার মধ্যে ক্লান্তি নেই, ছুটীর দাবী নেই, বেতন প্রার্থনা নেই, সমস্ত বিশ্বের সেই জিনিস পাথরের মূলে উৎসের মতো আমার মধ্য দিয়ে যদি উৎসারিত হয়ে থাকে, তবে তাই রইল । তা ছাড়া বাইরের গড় জিনিসের, ইট-কাঠের ইমারতের, নিয়মে বাধা প্রতিষ্ঠানের কালের হাতে নিস্তার নেই – ফুল প্রতি বসন্তে ফিরে ফিরে আসে, তার মধ্যে ক্ষতি নেই—সে বিশ্বের সহজ সামগ্ৰী । আমার কাজের মধ্যেও সত্যের যদি স্থনররূপ কিছু আপনি দেখা দিয়ে থাকে, তবে ক্ষণে ক্ষণে অন্তধর্ণনের মধ্য দিয়েও সে থাকৃবে। অনেক কিছু আছে যা জীর্ণ হ’য়ে যাবে, বাকি কিছু রইল ভাবী কাল যা তুলে নেবে। তা হোক ; কি থাকৃবে কি না থাকৃবে, তা ভাববারও দরকার নেই। দরকার আপনাকে পাওয়া, বারে বারে নতুন ক’রে পাওয়া । আজ সেই অপৰ্য্যাপ্ত নতুনকে অনুভব করূচি। যার হুকুম নিয়ে এসেছি, একদিন তিনি যে বাণী আমার প্রাণে সঞ্চার ক’রে দিয়েছেন, দেখছি আজো তা শেষ হয় নি, অথচ দিন শেষ হ’য়ে এল । ভিতরকার যে প্রকাশ অসমাপ্ত রয়ে গেল, রাত্রির অন্ধকারেই কি তার একান্ত অবসান ? হয়ত প্রত্যুষ এসেছে বা, আর এক জন্মের জন্য পাথেয় আজ হয় ত এসে পৌছল। এই কথা চিন্থা ক’রে আপনাদের সকলকে আমার নমস্কার জানিয়ে বিদায় গ্রহণ করি । ১৩৩৩ সালের ২৫ বৈশাখ শ্ৰীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মোৎসব উপলক্ষ্যে র্তাহার বক্তৃতার সারাংশ । শ্ৰীযুক্ত সন্তোষচন্দ্র মজুমদার কর্তৃক অনুলিখিত এবং কবির দ্বার সংশোধিত ।