পাতা:প্রবাসী (সপ্তত্রিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).pdf/৪৪৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

NESe প্রবাসী SN?88 এখানে রাইন নদী খুব চওড়া, আর উভয় তীরে দিগম্ভ পৰ্যন্ত চলে গেছে স্নিগ্ধ সবুজ শশুক্ষেত্রগুলি। দূর দিগন্তের কোলে হালকা মেঘখণ্ডগুলির দিকে তাৰিয়ে আমাদের বাল্যের সহচরী কীৰ্ত্তিনাশার কথা মনে পড়ল। গ্রীষ্মের কত অলস মধ্যাহ্নে আমাদের বাড়ীর দুর্গামগুপের পিছনে তালগাছটির ছায়ায় বসে নারায়ণগঞ্জ থেকে গোয়ালন্দগামী ষ্টীমারগুলির ধূমরচিত মেঘরাশির দিকে তাকাতে তাকাতে দূর দেখার আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠত। এত অল্প বয়সেই পদ্মার স্রোতের মধ্যে যে গতির আনন্দের সন্ধান পেয়েছিলাম তাকে নিজের অভিজ্ঞতার মধ্যে পেতে গিয়ে অনেক বার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে পৰ্যন্ত দাড়াতে হয়েছিল। ছোট ছোট ডিঙি নিয়ে দুই-তিন বন্ধুতে মিলে পয়ার সেই উন্মত্ত স্রোতের মধ্যে দূর দেখতে বেরিয়ে পড়তাম। অকস্মাৎ কখনও কখনও বড় উঠত। কয়েক বার সাতার কেটে ভীরে এসে পৌছেছি, আবার কখনও দৈবক্রমে জেলে, নৌকোর সাহায্যে উদ্ধার পেয়েছি। পদ্মার সেই স্লোতের কথা স্মরণ করে রাইনকেও অত্যন্ত অকিঞ্চিংকর মনে হ’ল । ডিনারের পর যখন ডেকে এসে বসলাম তখন জাহাজ সাগরে এসে পড়েছে, আর এক দিকে ডেনমার্কের তীর দেখা যাচ্ছে। একখানা বই নিয়ে পড়বার চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু এক জন সহষাত্রিণীর সঙ্গীতচর্চায় মনটা একটু উদাসী হয়ে উঠল। উন্মুক্ত নীল আকাশের নীচে, অশান্ত সাগরের বিরামহীন জলোচ্ছ্বাসের মধ্যে পিয়ানোর মৃদ্ধ সঙ্গীত সেদিন এক অদ্ভূত মোহময় আবেষ্টনের স্বষ্টি করেছিল। মনে পড়ল আউটরাম্ ঘাটের এক শীতের সন্ধ্যার কথা। পরীক্ষার পড়ার চাপে কিছু দিন অনেক রাত পৰ্য্যন্ত জেগে পড়তে হ’ত । স্কটিশ চার্চের এক হোষ্টেলে ঘে-পাড়ায় আমরা থাকতাম সেখানকার কোলাহল শেষ হ’তে রাত একটা দুটো বাজত। তখন সেই নিগুৰতার মধ্যে গঙ্গাবক্ষ থেকে ভেসে আসত সমুদ্রগামী জাহাজগুলির গভীর কণ্ঠের আহবান। পরীক্ষাগ্রস্ত বন্দী মন বিদ্রোহ করে উঠত একটা অদৃষ্ট অনিশ্চিত দূরের জাহানে। তাই হঠাৎ এক দিন খেয়াল হ’ল জাহাজগুলি দেখে আসবার । এক বন্ধুকে নিয়ে গেলাম আউটুৱা ঘাটে ; গঙ্গাবক্ষে সেই অসংখ্য আলোকমণ্ডিত ভাসমান দ্বীপপুঞ্জের মধ্যে জীবনের ষে চাঞ্চল্য চলছিল জলের ধারে বসে অনেক রাত পৰ্য্যস্ত একান্ত মনে তাই লক্ষ্য করছিলাম । সেদিন জাহাজের পিয়ানোর স্বরের মধ্যে যে মাদকতা এবং প্রেরণার জাস্বাদ পেয়েছিলাম, উত্তর-মেরুর সান্নিধ্যে এসেও আজকার মোহময় সঙ্গীতে পেলাম সেই একই অতৃপ্তির স্পর্শ। দুই অসীমের সঙ্গমস্থলে কাগজের নৌকোর মত আমাদের জাহাজখানি জল কেটে চলল তীব্র গতিতে, ক্রমশ উত্তর হতে আরও উত্তরে । ওঁসলে দেখে প্রথমটাতে হতাশ হয়েছিলাম। নরওয়ে সম্বন্ধে আমার সমস্ত কল্পনা ধাক্কা খেয়েছিল এই সাদাসিধে ছোটখাট চাঞ্চল্যহীন রাজধানীটিকে দেখে। এত বড় একটা ভাইকিং-সভ্যতার কোন চিহ্নই খুজে পেলাম না এথানে। ইতিহাসে পড়েছিলাম এই ভাইকিংদের কীৰ্ত্তির কথা। প্রায় তিন-শ বছর ধরে সমস্ত উত্তর-ইউরোপটকে সন্ত্রস্ত ক'রে রেখেছিল এই পেগান সম্প্রদায়ের দিগ্বিজয় অভিধান। খ্ৰীষ্টের জন্মের এক হাজার বছর পরেও নরওয়ে আর স্বইডেনে পূজা হ’ত পেগান দেবদেবীর—জডিন, টর ও ফাইরে। নিৰ্ম্মম প্রকৃতির শাসনের সঙ্গে সঙ্গে তার নিয়তির অবশুম্ভাবিত্বকেও মেনে নিত। জায়লাও থেকে বসফরাস পর্ষ্যস্ত এমন কোন জনপদ নেই যেখানে ভাইকিংউপনিবেশ গড়ে ওঠে নি। দীর্ঘ শীতের রাত্রির পরে যখন বসস্তের প্রথম আলো দেখা দিত, তাকে অভিনশিতে করতে গিয়ে সপ্তডিঙা মধুকর সাজিয়ে পুঞ্জীভূত উল্লাসের সঙ্গে তারা বেরিয়ে পড়ত দুর্জয় অভিধানে { তারা খালি লুটতরাজই করে নি, বিভিন্ন দেশে স্থাপন করেছে সমৃদ্ধিশালী বন্দর। হাম্বুর্গ, লুবেক-এর হানস লীগের প্রতিষ্ঠাতা ছিল ভাইকিংরাই । রাশিয়াকে তার সর্বপ্রথম রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা এনে দিয়েছিল এরাই। ইংলগুের প্রথম রাষ্ট্রীয় নেতা এবং সংস্কারক রাজা ক্যানিউটও ছিলেন এক জন ভাইকিং-বংশধর, অথচ ওলোতে এসে এই লুপ্ত সভ্যতার তখন কোন উজ্জল চিহ্ন খুঁজে পেলাম না। একমাত্র লোকতত্ত্বের মিউজিয়মে (Folk Museum ) দেখতে পেলাম ভাইকিংরা ষে-জাহাজ নিয়ে সাগর পাড়ি দিত তার তিনখানার ভগ্নাবশেষ ; সম্প্রতি নরওয়ের উত্তর-পশ্চিম