পাতা:বক্সা ক্যাম্প.djvu/১৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

বিচ্ছিন্ন করার শক্তি ইংরেজ গভর্নমেণ্টেরও ছিল না। তাই দেয়ালের বাধা ডিঙ্গাইয়া সিউড়ী জেলেও শীত দেখা দিল।

 শীতকে অনেকে সন্ন্যাসীর সঙ্গে তুলনা করিয়াছেন। তুলনটা মিথ্যা নয়। সন্ন্যাসীর কথা মনে হইলেই শুষ্ক, কঠিন, আভরণ-শূন্য মূর্তি চোখের সামনে ভাসিয়া উঠে। সর্ব আভরণ-রিক্ত তপস্বী ও সন্ন্যাসীর সঙ্গে শীতের যে কতখানি সাদৃশ্য, তাহা আমার সেলের ছোট্ট ইয়ার্ডের মধ্যে থাকিয়াই দেখিতে পাইলাম, এজন্য বাহির পৃথিবীর প্রকাণ্ড মূর্তিটি দেখিবার আবশ্যক রহিল না।

 আমার সাঁওতাল ফালতু ভোরেই ডেক চেয়ারটাকে বাহির করিয়া ইয়ার্ডে পাতিয়া রাখিয়া গিয়াছিল। পায়ের কাছে কাঠের চেয়ারটায় দু পা তুলিয়া দিয়া পূর্বমুখী হইয়া আরাম-আসনে পড়িয়াছিলাম। চোখ তুলিতেই দেখিতে পাইলাম, দেয়াল ডিঙ্গাইয়া অশ্বত্থের একটি ডাল এদিকে ইয়ার্ডের মধ্যে অনধিকার প্রবেশ করিয়াছে, আর সঙ্গে আসিয়াছে বুড়ো নিমগাছটার কয়েকটা ডাল। অশ্বত্থের পাতা ঝরিয়া একেবারে রিক্ত শাখা হইয়াছে। নিমগাছটার শাখা-প্রশাখায় কিছু পাতা ঝরিবার জন্য তখনও টিকিয়া আছে। যে অনুরাগে বা বৈরাগ্যে শীতের পৃথিবী তপস্বিনী সাজে, তার চিহ্ন আমার মাথার উপরে প্রসারিত রিক্ত ও নগ্ন শাখা কয়টিতেই দেখিতে পাইলাম।

 যে বাতাস গায়ে আসিয়া লাগিতেছিল, তাতেও সেই একই চিহ্ন পরিস্ফুট। উপমার সাহায্য লইতেছি—এ বাতাস যেন তান্ত্রিক সন্ন্যাসীর কণ্ঠস্বর, রসের বা বাষ্পের কোন আর্দ্রতা বা আবিলতা ইহাতে নাই। কঠিন, শুষ্ক ও তুহীনশীতল এই বাতাস, শবাসনে আসীন তান্ত্রিকের নিশ্বাস যেন, প্রাণের স্পর্শ নিঃশেষে নিষ্পেষিত। ঘাড় তুলিয়া উর্দ্ধে দৃষ্টি প্রেরণ করিলাম, আকাশের গায়ে গিয়া তাহা আবদ্ধ হইল। শীতের আকাশ, মেঘের ছায়া বা মায়া কোনটারই লেশমাত্র নাই। যেন সন্ন্যাসীর উদ্ধত রুক্ষ ললাট, সমস্ত চিন্তাকে পিষিয়া অথবা মুছিয়া ফেলা হইয়াছে সেখান হইতে, ধ্যান-গম্ভীর মূর্তি এই শীতের আকাশের। মাঝে