পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (দ্বিতীয় ভাগ).djvu/৩১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

দুর্গেশনন্দিনী হইতেছে, দুরাত্মা পাঠানের কোন মন্দ অভিপ্রায়ে আমাদের সঙ্গ লইয়াছে । তৎক্ষণাৎ বিমলার পথপার্শ্বস্থ মৃত অর্থ, উষ্ণাষ আর অশ্বসৈন্যের পদচিহ্ন স্মরণ হইল । তিনি কহিলেন,-“আপনি তবে এখানে অপেক্ষা করুন : আমি পলকমধ্যে দুর্গ হইতে বর্শী আনিতেছি ।” এই বলিয়া বিমলা ঝটিতি দুর্গমূলে গেলেন । যে কক্ষে বসিয়া সেই রাত্রি-প্রদোষে বেশবিদ্যাস করিয়াছিলেন, তাহার নীচের কক্ষের একটি গবাক্ষ আম্রকাননের দিকে ছিল । বিমলা অঞ্চল হইতে একটি চাবি বাহির করিয়া ঐ কলে ফিরাইলেন ; পশ্চাৎ জানালার গরাদে ধরিয়া দেয়ালের দিকে টান দিলেন, শিল্পকৌশলের গুণে জানালার কবাট, চৌকাট, গরাদে সকল সমেত দেয়ালের মধ্যে এক রন্ধে প্রবেশ করিল ; বিমলার কক্ষমধ্যে প্রবেশজন্য পথ মুক্ত হইল । বিমলা কক্ষমধ্যে প্রবেশ করিয়া দেয়ালের মধ্য হইতে জানালার চৌকাঠ ধরিয়া টানিলেন ; জানালী বাহির হইয়া পুনৰ্ব্বার পূর্বস্থানে স্থিত হইল ; কবাটের ভিতরদিকে পূৰ্ব্ববৎ গা-চাবির কল ছিল, বিমলা অঞ্চলে চাবি লইয়। ঐ কলে লাগাইলেন । জানাল নিজস্থানে দৃঢ়ৰূপে সংস্থাপিত হইল, বাহির হইতে উদঘাটিত হইবার সম্ভাবনা রহিল না। বিমলা অতি দ্রুতবেগে ফুর্গের শেলখানায় গেলেন ; শেলখানার প্রহরীকে কহিলেন—“আমি তোমার নিকট যাহা চাহি, তুমি কাহারও সাক্ষাতে বলিও না । আমাকে দুইটা বর্শ দাও —আবার অনিয়া দিব ।” প্রহরী চমৎকৃত হইল। কহিল,—“মা, তুমি বর্শ লইয়া কি করিবে ?” প্রত্যুৎপন্নমতি বিমলা কহিলেন,—“আজ আমার বীরপঞ্চমীর ব্রত, ব্ৰত করিলে বীরপুত্র হয় ; তাহাতে রাত্রে অস্ত্রপুঞ্জা করিতে হয় । আমি পুত্ৰকামনা করি, কাহারও সাক্ষাতে প্রকাশ করিও না ।" প্রহরীকে যেরূপ বুঝাইলেন, সেও সেইরূপ বুঝিল । দুর্গস্থ সকল ভৃত্য বিমলার আজ্ঞাকারী ছিল, সুতরাং দ্বিতীয় কথা না কহিয়া দুইটা শাণিত বর্শ দিল । বিমলা বর্শ লইয়৷ পূৰ্ব্ববেগে গবাক্ষের নিকট প্রত্যাগমন করিয়া পূৰ্ব্ববৎ ভিতর হইতে জানাল খুলিলেন এবং বর্শ সহিত নির্গত হইয়া জগৎসিংহের নিকট গেলেন । ব্যস্ততা প্রযুক্তই হউক বা নিকটেই থাকিবেন এবং তৎক্ষণেই প্রত্যাগমন করিবেন, এই বিশ্বাসজনিত নিশ্চিন্তভাবপ্রযুক্তই হউক, বিমল বহির্গমনকালে জালরক্ত পথ পূৰ্ব্ববৎ অবরুদ্ধ করিয়া যান নাই । షీS ইহাতে প্রমাদ ঘটনার এক কারণ উপস্থিত হইল । জানালার অতি নিকটে এক আম্রবৃক্ষ ছিল, তাহার অন্তরালে এক শস্ত্রধারী পুরুষ দণ্ডায়মান ; সে বিমলার এই ভ্ৰম দেখিতে পাইল । বিমলা যতক্ষণ না দৃষ্টিপথ অতিক্রম করিলেন, ততক্ষণ শস্ত্রপাণি পুরুষ বৃক্ষের অন্তরালে রছিল, বিমলা দৃষ্টির অগোচর হইলেই সে ব্যক্তি বৃক্ষমূলে শব্দশীল-চৰ্ম্মপাছকা ত্যাগ করিয়া শনৈঃ শনৈঃ পদবিক্ষেপে গবাক্ষসন্নিধানে আসিল । প্রথমে গবাক্ষের মুক্তপথে কক্ষমধ্যে দৃষ্টিপাত করিল, কক্ষমধ্যে কেহ নাই দেখিয়া নিঃশবো প্রবেশ করিল । পরে সেই কক্ষের দ্বার দিয়া অস্তঃপুরমধ্যে প্রবেশ করিল। এ দিকে রাজপুল বিমলার নিকট বর্শ পাইয়া পূৰ্ব্ববৎ বৃক্ষারোহণ করিলেন এবং পূৰ্ব্বলক্ষিত বৃক্ষে দৃষ্টিপাত করিলেন, দেখিলেন যে, এক্ষণে একটিমাত্র উষ্ণীষ দেখা যাইতেছে, দ্বিতীয় ব্যক্তি তথায় নাই ; রাজপুত্র একটি বর্শা বামকরে রাখিয়া দ্বিতীয় বর্শ দক্ষিণ করে গ্রহণ পূর্বক বৃক্ষস্থ উকীষ লক্ষ্য করিলেন, পরে বিশাল-বাহুবলসহযোগে বর্শা নিক্ষেপ করিলেন ; তৎক্ষণাৎ প্রথমে বৃক্ষপল্লবের প্রবল মৰ্ম্মর শব্দ, তৎপরেই ভূতলে গুরুপদার্থের পতন-শব হইল, উষ্ণৗষ আর বৃক্ষে নাই ; রাজপুত্ৰ বুঝিলেন, তাহার অব্যর্থ সন্ধানে উষ্ণীৰধারী বৃক্ষশাখাচু্যত হইয়া ভূতলে পড়িয়াছে । জগতসিংহ দ্রুতগতি বৃক্ষ হইতে অবতরণ করিয়া, বথ আহত ব্যক্তি পতিত হইয়াছে, তথা গেলেন ; দেখিলেন যে, এক জন সৈনিকবেশধারী সশস্ত্র মুসলমান মৃতবৎ পতিত হইয়া রহিয়াছে। বর্শ তাহার চক্ষুর পাশ্বে বিদ্ধ হইয়াছে । রাজপুত্র মৃতবৎ দেহ নিরীক্ষণ করিয়া দেখিলেন যে, একেবারে প্রাণবিয়োগ হইয়াছে। বর্শ চক্ষুর পাশ্বে বিদ্ধ হইয় তাহার মস্তিষ্ক ভেদ করিয়াছে । মৃতব্যক্তির কবচমধ্যে একখানা পত্র ছিল । তাহার অল্পভাগ বাহির হইয়াছিল, জগৎসিংহ ঐ পত্র লইয়া জ্যোৎস্নায় আনিয়া পাঠ করিলেন, তাহাতে এইরূপ লেখা ছিল ;– “কতলু খাঁর আজ্ঞানুবৰ্ত্তিগণ এই লিপি বৃষ্টিমাত্র লিপিবাহকের আজ্ঞা প্রতিপালন করিবে ।” কতলু খ৷ ” বিমল কেবল শবদ শুনিতেছিলেন মাত্র, সবিশেষ কিছুই জানিতে পারেন নাই । রাজকুমার তাহার নিকটে আসিয়া সবিশেষ বিবৃত করিলেন । বিমলা শুনিয়া কহিলেন, “যুবরাজ ! আমি এত জানিলে