পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (প্রথম ভাগ).djvu/১০১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৯৬ ক্ষমা করিতে পারি না । অতএব যুদ্ধ যেমন চলিতে ছিল, তেমনই চলিবে । রাণার রাজ্যমধ্যে গোরু দেখিলে, মুসলমান তাহ মারিয়া ফেলিবে । দেবালয় দেখিলেই তাহা ভগ্ন করিবে । জেজেয়া সৰ্ব্বত্রই আদায় হইবে।” এই সকল হুকুম জারি হইল। এ দিকে দিলীর খ দাইমুরীর পথ দিয়া মাড়বার হইতে উদয়পুরে প্রবেশের চেষ্টায় আসিতেছেন, শুনিয়া রাজসিংহ ঔরঙ্গজেবের কাছে লোক পাঠাইলেন এবং জিজ্ঞাসা করিলেন যে, সন্ধির পর আবার যুদ্ধ কেন ? ঔরঙ্গজেব বলিলেন, “ভূইয়ার সঙ্গে বাদশাহের সদ্ধি ? বাদশাহের রূপনগরী বেগম ফেরৎ না পাঠাইলে বাদশাহ তোমাকে ক্ষমা করিবেন না ।” শুনিয় রাজসিংহ হাসিয়া বলিলেন, “আমি এখনও জীবিত আছি ।” রূপনগরের রাজকুমারীর অপহরণটা ঔরঙ্গজেবের শেল সমান বিধিতেছিল। তিনি রাজসিংহের নিকট অভীষ্টসিদ্ধির সম্ভাবনা নাই বিবেচনা করিয়া রূপনগরের *রাও সাহেবকে” এক পরওয়ান দিলেন । তাহাতে লিখিলেন, “তোমার কন্যা এখনও আমার নিকট উপস্থিত হয় নাই। শীঘ্র তাহাকে উপস্থিত করিবে, নহিলে রূপনগরের গড়ের চিহ্ন রাখিব ন৷ ” ঔরঙ্গজেবের ভরসা যে, পিতা জিদ করিলে চঞ্চলকুমারী তাহার নিকটে আসিতে সম্মত হইতে পারে । পরওয়ান পাইয়া বিক্রমসিংহ উত্তর লিখিল, “আমি শীঘ্র দুই হাজার অশ্বারোহী সেনা লইয়া আপনার হুজুরে হাজির হইব ।” ঔরঙ্গজেব ভাবিলেন, “সেনা কেন ?” মনকে এইরূপ বুঝাইলেন যে, তাহার সাহায্যার্থ বিক্রমসিংহ সেনা লইয়া আসিতেছে। ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ মবারকের দাহনারম্ভ সৌন্দর্য্যের কি মহিমা ! মবারক জেব উন্নিসাকে দেখিয়া আবার সব ভুলিয়া গেল । গৰ্ব্বিত, স্নেহভাৰদৰ্পে প্রফুল্লা জেব উন্নিসাকে দেখিলে আর তেমন হইত কি না বলা যায় না, কিন্তু সেই জেবউল্লিগ এখন বিনীতা, দৰ্পশুষ্ঠা, স্নেহশালিনী, অশ্রময়ী। মৰারকের পূৰ্ব্বানুরাগ সম্পূর্ণরূপে ফিরিয়া আসিল । দরিয়া, দরিয়ায় ভাসিয়া গেল। মনুষ্য স্ত্রীজাতির প্রেমে অন্ধ হইলে, আর তাহার হিতাহিত ধৰ্ম্মাধৰ্ম্মজ্ঞান থাকে না। তাহার মত বিশ্বাসঘাতক পাপিষ্ঠ আর নাই। বঙ্কিমচন্দ্রের গ্রন্থাবলী .$ ·鄰 靠 .م . م". সহস্র দীপের রশ্মি প্রতিবিম্বসমন্বিত উদয়সাগরের অন্ধকার জলের চতুষ্পাখে পৰ্ব্বতমালা নিরীক্ষণ করিতে করিতে, পটমগুপের দুর্গমধ্যে ইন্দ্রভবন তুল্য কক্ষে বসিয়া মবারক জেব উন্নিসার হাত আপন হাতের ভিতর তুলিয়া লইল । মবারক বড় দুঃখের সহিত বলিল, “তোমাকে আবার পাইয়াছি, কিন্তু দুঃখ এই ষে, এই সুখ দশ দিন ভোগ করিতে পারিলাম না ।" জেব-উন্নিসা । কেন ? কে বাধা দিবে ? বাদশাহ ? মবারক । সে সন্দেহও আছে । কিন্তু বাদশাহের কথা এখন বলিতেছি না । আমি কাল যুদ্ধে যাইব । যুদ্ধে মরণ জীবন দুই আছে । কিন্তু আমার পক্ষে মরণ নিশ্চয় । আমি রাজপুতদিগের যুদ্ধের ষে বন্দোবস্ত দেখিয়াছি, তাহাতে আমি নিশ্চিত জানি যে, পাৰ্ব্বত্য যুদ্ধে আমরা তাহাদিগকে পরাভব করিতে পারিব না । আমি একবার হারিয়া আসিয়াছি, আর একবার হারিয়া আসিতে পারিব না । আমাকে যুদ্ধে মরিতে হইবে । জেব উন্নিসা সজল-নয়নে বলিল, “ঈশ্বর অবস্ত করিবেন যে, তুমি যুদ্ধে জয়ী হইয়া আসিবে । তুমি আমার কাছে না আসিলে আমি মরিব ।” উভয়ে চক্ষুর জল ফেলিল । তখন মবারক ভাবিল, “মরিব, ন| মরিব না ?” অনেক ভাবিল । সম্মুখে এই নক্ষত্ৰখচিত গগনস্পর্শী পৰ্ব্বতমালাপরিবেষ্টিত অন্ধকার উদয়সাগরের জল—তাহাতে দীপমালী-প্রভাসিত পটনিৰ্ম্মিত মহানগরীর মনোমোহিনী ছায়া—দূরে পর্বতের চুড়ার উপর চুড়া - তার উপর চুড়া-বড় অন্ধকার। দুই জনে বড় অন্ধকারই দেখিল । সহসা জেব উল্লিসা বলিল, “এই অন্ধকারে শিবিরের প্রাচীরের তলায় কে লুকাইল ? তোমার জন্য আমার মন সৰ্ব্বদ শঙ্কিত ” “দেখিয়া আসি,” বলিয়া মবারক চুটিয়া দুর্গ প্রাকারতলে গেলেন, দেখিলেন, এক জন যথার্থই লুকাইয়া শুইয়া আছে বটে । মবারক তাহাকে ধৃত করিলেন । হাত ধরিয়া তুলিলেন । ষে লুকাইয়াছিল, সে দাড়াইয়া উঠিল। অন্ধকারে মবারক কিছু ঠাওর পাইলেন না। তাহাকে টানিয়া দুর্গমধ্যে দীপালোকের নিকট আনিলেন । দেখিলেন যে, একটা স্ত্রীলোক । সে মুখে কাপড় দিয়া মুখ ঢাকিয়া রহিল-মুখ খুলিল না । মবারক তাহাকে এক জন প্রতিহারীর জিম্মায় রাখিয়া স্বয়ং জেবাউন্নিসার নিকটে গিয়া সবিস্তার নিবেদন করিলেন। জেৰ উল্লিস কৌতুহলবশতঃ তাহাকে কক্ষমধ্যে আনিতে অনুমতি দিলেন। মবারক তাহাকে কক্ষমধ্যে লইয়া আসিলেন ।