বিষয়বস্তুতে চলুন

পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (প্রথম ভাগ).djvu/৫০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রাজসিংহ ম। আমাদের শক্ৰ আছে, তাই মরি । ভুবনে কি আপনার শত্রু আছে ? চ । আমি নিজে— ম। আমাদের শত্রুর অনেক প্রকার অস্ত্র অাছে —আপনার ? চ। বিষ । ম । কোথায় আছে ? বলিয়া মবারক চঞ্চলকুমারীর মুখপানে চাহিলেন । বুঝি অন্য কেহ হইলে তাহার মনে মনে হইত, নয়ন ছাড়া আর কোথাও বিয আছে কি ? কিন্তু মবারক সে ইতর-প্রকৃতির মনুষ্য ছিলেন না । তিনি রাজসিংহের লুলয় যথার্থ বীরপুরুষ । তিনি বলিলেন, “মা, আত্মঘাতিনী কেন হইবেন ? আপনি যদি যাইতে না চাহেন, তবে আমাদের সাধ্য কি আপনাকে লইয়া যাই ? স্বয়ং দিল্লীশ্বর উপস্থিত থাকিলেও আপনার উপর বল প্রকাশ করিতে পারিতেন না—আমরা কোন ছার! আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন –কিন্তু এ রাজপুতের বাদশাহের সেনা আক্রমণ করিয়াছে— আমি মোগল সেনাপতি হইয়া কি প্রকারে উহাদের ক্ষমা করি ?” চ। ক্ষমা করিয়া কাজ নাই—যুদ্ধ করুন। এই সময়ে রাজপুতগণ লইয়া রাজসিংহ সেইখানে উপস্থিত হইলেন—তখন চঞ্চলকুমারী বলিতে লাগিলেন, “যুদ্ধ করুন—রাজপুতের মেয়েবাও মরিতে জানে।” মোগল সেনাপতির সঙ্গে ‘লজ্জাহীন চঞ্চল কি কথা কহিতেছে, শুনিবার জন্য রাজসিংহ এই সময়ে চঞ্চলের পাশ্বে আসিয়া দাড়াইলেন । চঞ্চল তখন তাহার কাছে হাত পাতিয়া হাসিয়া বলিলেন, “মহারাজাধিরাজ, আপনার কোমরে যে তরবারি বুলিতেছে, রাজপ্রসাদস্বরূপ দাসীকে উহা দিতে আজ্ঞা হউক ৷” রাজসিংহ হাসিয়া বলিলেন, “বুঝিয়াছি, তুমি সত্য সত্যই ভৈরবী ” এই বলিয়া রাজসিংহ কটি হইতে অসি নিন্মুক্ত করিয়া চঞ্চলকুমারীর হাতে দিলেন । দেখিয়া মোগল ঈষৎ হাসিল । চঞ্চলকুমারীর কথার কোন উত্তর করিল না । কেবল রাজসিংহের মুখপানে চাহিয়া বলিল, “উদয়পুরের বীরেরা কত দিন হইতে স্ত্রীলোকের বাহুবলে রক্ষিত ?” রাজসিংহের দীপ্ত চক্ষু হইতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নিৰ্গত হইল । তিনি বলিলেন, “যত দিন হইতে মোগল বাদশাহ অবলাদিগের উপর অত্যাচার আরম্ভ 86t করিয়াছেন, তত দিন হইতে রাজপুতকন্যাদিগের বাহুতে বল হইয়াছে।” তখন রাজসিংহ সিংহের ন্যায় গ্রীবাভঙ্গের সহিত স্বজনবর্গের দিকে ফিরিয়া বলিলেন, “রাজপুতের বাগ যুদ্ধে অপটু ৷ ক্ষুদ্র সৈনিকদিগের সঙ্গে বাগযুদ্ধের আমার সময়ও নাই, বৃথা কালহরণে প্রয়োজন নাই—পিপীলিকার মত এই মোগলদিগকে মারিয়া ফেল ।” এতক্ষণ বর্ষণোন্মুখ মেঘের ন্যায় উভয় সৈন্ত স্তম্ভিত হইয়া ছিল— প্রভুর আজ্ঞ ব্যতীত কেহই যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইতে পারিতেছিল না। এক্ষণে রাণার ” আজ্ঞা পাইয়া “মাতাজীকি জয়” শবে রাজপুতের জলপ্রবাহবৎ মোগল-সেনার উপরে পড়িল । এ দিকে মবারকের আজ্ঞা পাইয়। মোগলেরা “আল্লাহো—আকবর !" শব্দ করিয়া তাহাদের প্রতিরোধ করিতে উদ্যত হইল। কিন্তু সহসা উভয় সেনাই নিম্পন্দ হষ্টয় দাড়াইল । সেই রণক্ষেত্রে উভয় সেনার মধ্যে অসি উত্তোলন করিয়া—স্থিরমূৰ্ত্তি চঞ্চলকুমারী দাড়াইয়া—সরিতেছেন না । চঞ্চলকুমারী উচ্চৈঃস্বরে বলিতে লাগিলেন, “যতক্ষণ না এক পক্ষ নিবৃত্ত হয়, ততক্ষণ আমি এখান হইতে নড়িব না । অগ্রে আমাকে ন৷ মারিয়া কেহ অস্ত্রচালনা করিতে পারিবে না।” রাজসিংহ রুষ্ট হইয়া বলিলেন, “তোমার এ অকৰ্ত্তব্য। স্বহস্তে তুমি রাজপুতকুলে কলঙ্ক লেপিতেছ কেন ? লোকে বলিবে, আজ স্ত্রীলোকের সাহায্যে রাজসিংহ প্রাণরক্ষা করিল ।” চ। মহারাজ, আপনাকে মরিতে কে নিষেধ করিতেছে ? আমি কেবল আগে মরিতে চাহিতেছি । যে অনর্থের মূল, তাহার আগে মরিবার অধিকার আছে । চঞ্চল নড়িল না—মোগলের বন্দুক উঠাইয়াছিল —নামাইল । মবারক চঞ্চলকুমারীর কার্য্য দেখিয়া মুগ্ধ হইলেন । তখন উভয় সেনা-সমক্ষে মবারক ডাকিয়া বলিলেন, “মোগল-বাদশাহ স্ত্রীলোকের সহিত যুদ্ধ করেন না—অতএব বলি, আমরা এই সুন্দরীর নিকট পরাভব স্বীকার করিয়া যুদ্ধ ত্যাগ করিয়া যাই । রাণী রাজসিংহের সঙ্গে যুদ্ধে জয়পরাজয়ের মীমাংসা, ভরসা করি, ক্ষেত্রাস্তরে হইবে । , আমি রাণাকে অনুরোধ করিয়া যাইতেছি যে, সেবার ষেন স্ত্রীলোক সঙ্গে করিয়া না আইসেন।” চঞ্চলকুমারী মবারকের জন্য চিন্তিত হইলেন। মবারক তখন র্তাহার নিকটে—অশ্বে আরোহণ