পাতা:বঙ্কিম রচনাবলী (প্রথম খণ্ড).pdf/৭৪৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

দ্বিতীয় খণড প্রথম পরিচ্ছেদ শান্তির অল্পবয়সে, অতি শৈশবে মাতৃবিয়োগ হইয়াছিল। যে সকল উপাদানে শান্তির চরিত্রে গঠিত, ইহা তাহার মধ্যে একটি প্রধান। তাহার পিতা অধ্যাপক ব্রাহ্মণ ছিলেন। তাঁহার গাহে অন্য সত্ৰীলোক কেহ ছিল না। কাজেই শান্তির পিতা যখন টোলে ছাত্ৰাদিগকে পড়াইতেন, শান্তি গিয়া তাঁহার কাছে বসিয়া থাকিত। টোলে কতকগালি ছাত্র বাস করিত ; শান্তি অন্য সময়ে তাহাদিগের কাছে বসিয়া খেলা করিত, তাহাদিগের কোলে পিঠে চড়িত; তাহারও শান্তিকে আদর করিত ! এইরপ শৈশবে নিয়ত পরিষসাহচয্যের প্রথম ফল। এই হইল যে, শান্তি মেয়ের মত কাপড় পরিতে শিখিল না, অথবা শিখিয়া পরিত্যাগ করিল। ছেলের মত কোঁচা করিয়া কাপড় পরিতে আরম্ভ করিল, কেহ কখন মেয়ে কাপড় পরাইয়া দিলে, তাহা খলিয়া ফেলিত, আবার কোঁচা করিয়া পরিত। টোলের ছাত্রেরা খোঁপা বাঁধে না; অতএব শান্তিও কখন খোঁপা বাঁধিত না— কে বা তার খোঁপা বাঁধিয়া দেয় ? টোলের ছাত্রেরা কাঠের চিরনি দিয়া তাহার চুল অাঁচড়াইয়া দিত, চুলগােলা কুন্ডলী করিয়া শান্তির পিঠে, কাঁধে, বাহতে ও গালের উপর দলিত। ছাত্রেরা ফোঁটা করিত, চন্দন মাখিত ; শান্তিও ফোঁটা করিত, চন্দন মাখিত। যজ্ঞোপবীত গলায় দিতে পাইত না বলিয়া শান্তি বড় কাঁদত। কিন্তু সন্ধ্যাহিকের সময়ে ছাত্রদিগের কাছে বসিয়া, তাহাদের অন্যাকরণ করিতে ছাড়িত না। ছাত্রেরা অধ্যাপকের অবত্তমানে, অশলীল সংস্কৃতের দই চারিটা বকিনি দিয়া, দই একটা আদিরসাশ্রিত গলপ করিতেন, টিয়া পাখীর মত শান্তি সেগালিও শিখিল—টিয়া পাখীর মত, তাহার অর্থ কি, তাহা কিছই জানিত না। দ্বিতীয় ফল। এই হইল যে, শান্তি একটি বড় হইলেই ছাত্রেরা যাহা পড়িত, শান্তিও তাহাদের সঙ্গে সঙ্গে শিখিতে আরম্ভ করিল। ব্যাকরণের এক বর্ণ জানে না, কিন্তু ভট্টি, রঘ, কুমার, নৈষধাদির শোলাক ব্যাখ্যা সহিত মখস্থ করিতে লাগিল। দেখিয়া শনিয়া, শান্তির পিতা “যদভবিষ্যতি তদভবিষ্যতি” বলিয়া শান্তিকে মগধবোধ আরম্ভ করাইলেন। শান্তি বড় শীঘ্র শীঘ্ৰ শিখিতে লাগিল। অধ্যাপক বিস্ময়াপন্ন হইলেন। ব্যাকরণের সঙ্গে সঙ্গে দই একখানা সাহিত্যও পড়াইলেন। তার পর সব গোলমাল হইয়া গেল। পিতার পরলোকপ্রাপিত হইল। তখন শান্তি নিরাশ্রয়। টোল উঠিয়া গেল ; ছাত্রেরা চলিয়া গেল। কিন্তু শান্তিকে তাহারা ভালবাসিত-শান্তিকে পরিত্যাগ করিয়া যাইতে পারিল না। একজন তাহাকে দয়া করিয়া আপনার গহে লইয়া গেল। ইনিই পশ্চাৎ সন্তানসম্প্রদােয়মধ্যে প্রবেশ করিয়া জীবানন্দ নাম গ্রহণ করিয়াছিলেন । আমরা তাঁহাকে জীবানন্দই বলিতে থাকিব । তখন জীবানন্দের পিতা-মাতা বৰ্ত্তমান । তাঁহাদিগের নিকট জীবানন্দ কন্যাটির সবিশেষ পরিচয় দিলেন। পিতা-মাতা জিজ্ঞাসা করিলেন, “এখন এ পরের মেয়ের দায় ভার নেয় কে ?” জীবানন্দ বলিলেন, “আমি আনিয়াছি—আমিই দায় ভার গ্রহণ করিব।” পিতা-মাতা বলিলেন, “ভালই।” জীবানন্দ অনড়—শান্তির বিবাহ বয়স উপস্থিত। অতএব জীবানন্দ তাহাকে বিবাহ করিলেন। বিবাহের পর সকলেই অন্যতাপ করিতে লাগিলেন। সকলেই বঝিলেন, “কাজটা ভাল হয়। নাই।” শান্তি কিছতেই মেয়ের মত কাপড় পরিল না; কিছতেই চুল বাঁধিল না। সে বাটীর ভিতর থাকিত না ; পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে মিলিয়া খেলা করিত। জীবানন্দের বাড়ীর নিকটেই জওগল, শান্তি জগুগলের ভিতর একা প্রবেশ করিয়া কোথায় মযর, কোথায় হরিণ, কোথায় দলভি ফল ফল, এই সকল খাজিয়া বেড়াইত। শব্বশর শাশড়ী প্রথমে নিষেধ, পরে ভৎসিনা, পরে প্রহার করিয়া শেষে ঘরে শিকল দিয়া শান্তিকে কয়েদ রাখিতে আরম্ভ করিল। পীড়াপীড়িতে শান্তির বড় জবালাতন হইল। এক দিন দাবার খোলা পাইয়া শান্তি কাহাকে না বলিয়া গহত্যাগ করিয়া চলিয়া গেল। জঙ্গলের ভিতর বাছিয়া বাছিয়া ফল তুলিয়া কাপড় ছোবাইয়া শান্তি বাচ্চা সন্ন্যাসী সাজিল। তখন বাঙ্গালা জড়িয়া দলে দলে সন্ন্যাসী ফিরিত। শান্তি ভিক্ষা করিয়া খাইয়া Գ88