পাতা:বঙ্কিম রচনাবলী (প্রথম খণ্ড).pdf/৯০০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সীতারাম নন্দা। ও সকল কথা কেন মখে আনি, দিদি ? বিধাতা যা কপালে লিখেছেন, তা অবশ্য ঘটিবে। কপালে মঙগল লিখিয়া থাকেন, মঙগলই হইবে। আমরা ত তাঁর পায়ে কোন অপরাধ করি নাই—আমাদের কেন মন্দ হইবে ? কেন তুমি ভাবিয়া সারা হও । আয়, পাশা খেলিবি ? তোর নাথের নাতন নোলক জিতিয়া নিই আয় । এই বলিয়া নন্দা, রমাকে অন্যমনা করিবার জন্য পাশা পাড়িল। রমা। অগত্যা এক বাজি খেলিল, কিন্তু খেলায় তার মন গেল না। নন্দা ইচ্ছাপাকবািক বাজি হরিল--রমার নাকের নোলক বাঁচিয়া গেল। কিন্তু রমা। আর খেলিল না—এক বাজি উঠিলেই রমাও উঠিয়া গেল। রমা নন্দার কাছে আপনি জিজ্ঞাস্য কথার উত্তর পায় নাই-—তাই সে খেলিতে পারে নাই । কতক্ষণে সে আর এক জনকে সে কথা জিজ্ঞাসা করিবে, সেই ভাবনাই ভাবিতেছিল। রমা। আপনার মহলে ফিরিয়া আসিয়াই আপনার একজন বাষীয়সী ধাত্রীকে জিজ্ঞাসা করিল, “হাঁ গা —মসলমানেরা কি ছেলে মারে ?” বাষীয়সী বলিল, “তাঁরা কাকে না মারে ? তারা গোর খায়, নেমাজ করে, তারা ছেলে মারে না ত কি ?” রমার বকের ভিতর ঢিপ ঢিপ করিতে লাগিল। রমা তখন যাহাকে পাইল, তাহাকেই সেই কথা জিজ্ঞাসা করিল, পরিবাসিনী আবালবাদ্ধা সকলকেই জিজ্ঞাসা কবিল। সকলেই মসলমানভয়ে ভীত, কেহই মসলমানকে ভাল চক্ষতে দেখে না।--সকলেই প্রায় বাষীয়সীর মত উত্তর দিল। তখন রমা সৰ্ব্বনাশ উপস্থিত মনে কািরয়া, বিছানায় আসিয়া শ্যইয়া পড়িয়া ছেলে কোলে লইয়া কাঁদিতে লাগিল । তৃতীয় পরিচ্ছেদ এ দিকে তোরাব খাঁ সংবাদ পাইলেন যে, সীতারাম মহম্মদপারে নাই, দিল্লী যাত্ৰা করিয়াছেন। তিনি ভাবিলেন, এই শােভ সময়, এই সময় মহম্মদপাের পোড়াইয়া ছারখার করাই ভাল। তখন তিনি সসৈন্যে মহম্মদপাের যাত্রা করিবার জন্য প্রস্তুত হইতে লাগিলেন। সে সংবাদও মহম্মদপারে পৌছিল। নগরে একটা ভারি হলস্থল পড়িয়া গেল। গহস্থের। যে, যেখানে পাইল, পলাইতে লাগিল। কেহ মাসীর বাড়ী, কহ পিসীর বাড়ী, কেহ খড়ার বাড়ী, কেহ মামার বাড়ী, কেহ শবশঙ্কুরবাড়ী, কেহ জামাইবাড়ী, কেহ বেহাইবাড়ী, বোনাইবাড়ী, সপরিবার, ঘটি-বাটি, সিন্দক, পেটারা, তক্তপোষ সমেত গিয়া দাখিল হইল। দোকানদার দোকান লইয়া পলাইতে লাগিল, মহাজন গোলা বেচিয়া পলাইতে লাগিল, আড়তদার আড়ত বেচিয়া পলাইল, শিলপকার যন্ত্ৰ-তন্ত্র মাথায় কবিয়া পলাইল। বড় হলেস্থল পড়িয়া গেল। নগররক্ষক গঙ্গারাম দাস, চন্দ্রচাড়ের নিকট মন্ত্রণার জন্য আসিলেন। বলিলেন, “এখন ঠাকুর কি করিতে বলেন ? সহর তা ভাঙিগয়া যায ।” চন্দ্রচড়ি বলিলেন, “স্ত্রীলোক বালক বন্ধ যে পলায় পালাক, নিষেধ করিও না। বরং তাহাতে প্রয়োজন আছে। ঈশবর না করন, কিন্তু তোরাব খাঁ আসিয়া যদি গড় ঘেরাও করে, তবে গড়ে যত খাইবার লোক কম থাকে, ততই ভাল, তা হলে দাই মাস ছয় মাস চালাইতে পারিব। কিন্তু যাহারা যাদ্ধ শিখিয়াছে, তাহদের এক জনকেও যাইতে দিবে না, যে যাইবে, তাহাকে গলি করিবার হকুম দিবে। অস্ত্ৰ-শস্ত্র একখানিও সহরের বাহিরে লইয়া যাইতে দিবে না। আর খাবার সামগ্রী এক মঠও বাহিরে লইয়া যাইতে দিবে না।” সেনাপতি মন্ময় রায় আসিয়া চন্দ্রচড়ি ঠাকুরকে মন্ত্রণা জিজ্ঞাসা করিলেন। বলিলেন, “এখানে পড়িয়া মারা খাইব কেন ? যদি তোরাব খাঁ আসিতেছে, তবে সৈন্য লইয়া অন্ধেক পথে গিয়া তাহাকে মারিয়া আসি না কেন ?" চন্দ্রচড়ি বলিলেন, “এই প্রবলা নদীর সাহায্য কেন ছাড়িব ? যদি অন্ধ পথে তুমি হার, তবে আর আমাদের দাঁড়াইবার উপায় থাকিবে না; কিন্তু তুমি যদি এই নদীর এ পারে। কামান সাজাইয়া দাঁড়াও, কারসাধ্য এ নদী পার হয় ? - এ হাঁটিয়া পার হইবার নদী নয়। সংবাদ রাখি, কোথায় নদী পার হইবে। সেইখানে সৈন্য লইয়া যাও, তাহা হইলে মাসলমান এ পারে আসিতে পরিবে না। সব প্রস্তুত রাখি, কিন্তু আমায় না বলিয়া হযাত্রা করিও না।” -- b ふ