পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (অষ্টম খণ্ড).pdf/১৪৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১১৮
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : অষ্টম খণ্ড

আল্লাহ ছাড়া আর কোন গতি নাই। তারপর আমরা দুই ভাই জেলের মধ্যে থেকে যাই। সেই দিন রাত ৮টার পর একটা পাক হানাদার বাহিনীর গাড়ী গিয়ে থানয় উপস্থিত হয় এবং একজন পাঞ্জাবী জেলের দরজায় গিয়ে বছিরকে ডাক দেয়। বছির নড়তে-চড়তে পারে না, দুই তিনজন বিহারী ও একজন পুলিশ বছিরকে হাজত হতে বের করে গাড়ীতে তুলে দেয়, গাড়ী চলে যায়। তার আধ ঘণ্টা পরেই আমরা সি, ও, অফিসের সম্মুখে একটা ফায়ারের শব্দ শুনতে পাই। আমরা মনে করলাম বছির হয়তো বাংলাদেশের মাটিতে হানাদার বাহিনীর গুলিতে মিশে গেল। আমরা দুই ভাই আল্লাহর নাম স্বরণ করতে থাকি। এবং মনে মনে বলতে থাকি এরপর মনে হয় আমাদের পালা। কোন মতে রাত্রি কেটে যায়। তার ৫/৭ দিন পর মেজর আবার আমাদের সাথে জেলে দেখা করে এবং বলে শালা বাঙ্গালীকা জাত, বড় হারামীহায়। শালা মাইন পৌঁতে হাম লোককে মারতে চায়। এবং আমাকে আরও বলে তোম লোককা দুনিয়াছে নেকাল করদেগা, আজ রাতমে তোম বিদায় নিয়ে গা। তারপর জয়পুরহাট চলে যায়। এর মধ্যে আমি জেলের একজন বাঙ্গালী পুলিশের মারফত শুনতে পাই যে, আমাদের দুই ভাই -এর জন্য কবর খোঁড়া হয়েছে সি, ও, অফিসের পার্শ্বে। এটা শোনার সাথে সাথে আল্লার নাম স্বরণ করতে থাকি। কিন্তু আয়ুব বিহারীর নির্দেশে জেলের মধ্যে আমার উপর কোন শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার করা হয় না। মেজর চলে যাওয়ার ৮/১০ দিন পর একজন বেলুচ মেজর পাঁচবিবি আসে। এসেই জেলে গিয়ে আমাদেরকে দেখতে পায়। তারপর কাগজপত্র দেখে ও,সি,কে নির্দেশ দেয় যে, এখনই আমাদেরকে বগুড়া সেণ্ট্রাল জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হোক। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দুই ভাইকে গাড়ীতে করে বগুড়া সেণ্ট্রাল জেলে পঠিয়ে দেয়। আমরা জেলে ঢুকে দেখতে পাই জেলের মধ্যে ৮০/৯০ জন বাঙ্গালী পড়ে আছে। তাদের কারুর শরীরের শত শত লাঠির আঘাতের চিহ্ন। আবার কারুর শরীরে শত শত বেয়োনেটের কোঁচার চিহ্ন। কারুর শরীর হতে অঝোরে রক্ত ঝরছে। দ্রুত সব দৃশ্যাবলী দেখে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। জেলের দারোয়ান আমাকে বলতে থাকে বুড্ডা তুম আর নেহি বাচেগা। তারপর আমরা জেলের মধ্যে ঢোকার আধ ঘণ্টা পর একজন পাঞ্জাবী লাঠি হাতে করে জেলের মধ্যে ঢোকে। সকলেই তাকে দেখে ভয়ে সন্ত্রস্ত হয়ে সড়ো চুপচাপ হয়ে বসে। তারপর পাঞ্জাবীটা ঘরের মধ্যে ঢুকেই কোন কথা না বলে এক এক করে সবার পিঠে একটা করে লাঠির আঘাত করে। তারপর আমার নিকট গিয়ে থমকে দাঁড়ায় এবং আমাকে জিজ্ঞাসাবদ করে বুড্ডু তুম কাহাছে আয়া। আমি জবাব দেই আমি পাঁচবিবি হতে এসেছি। আমার কোন দোষ নেই আমাকে বিহারীরা ধরিয়ে দিয়েছে। তারপর মিনিট পাঁচেক চুপ করে থাকে এবং আমাকে বলে বুড্ডা তোমার কোন ভয় নেহি। তারপর আমার ভাই এর নিকট গেলে আমি বলি আমার ছোট ভাই। তারপর তাকে কিছু জিজ্ঞাসা না করে জেল হতে বেরিয়ে চলে যায়। তারপর সন্ধ্যা নেমে এলে ৪/৫ জন লোককে জেল হতে বের করে কোথায় যেন নিয়ে যায়। তাদেরকে আর জেলে ফিরে নিয়ে আসে না। এই ভাবে প্রতি দিন ৪/৫ জন করে জেল হতে বের করে নিয়ে হত্যা করতো। কয়েকদিন পর বগুড়া শহরে আমার আত্মীয়ের তদ্বীরের দরুন মুক্তি পাই।

স্বাক্ষর/-
ফকির মামুদ মণ্ডল
৭/১১/৭৩