পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (তৃতীয় খণ্ড).pdf/৪৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ তৃতীয় পত্র
11

তাদের সমস্ত ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়ে গেছে। তাদের খাদ্য সরবরাহের সকল পথ আজ বন্ধ- ঢাকার সাথে আজ তাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। উড়োজাহাজ থেকে খাবার ফেলে এদেরকে ইয়াহিয়া খান আর বেশী দিন টিকিয়ে রাখতে পারবে না। ওদের জ্বালানী সরবরাহের লাইন আমাদের মুক্তিবাহিনী বন্ধ করে দিয়েছে। ইয়াহিয়ার উড়োজাহাজ আর বেশী দিন বাংলাদেশের আকাশে দেখা যাবে না। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি উত্তাল জনসমুদ্রের মাঝখানে ওরা আজকে বিছিন্ন দ্বীপের মত। বাংলাদেশের আকাশে শীঘ্রই ঝড়ের মাতন শুরু হচ্ছে। ওরা জানে ওরা হানাদার। ওরা জানে ওদের বিরুদ্ধে পৃথিবীর সমস্ত মানুষের ভ্রুকুটি ও ঘৃণা। ওরা ভীত, ওরা সস্ত্রস্ত মৃত্যু ওদের সামনে পরাজয়ের পরোয়ানা নিয়ে হাজির। তাই ওরা উন্মাদের মত ধ্বংস লীলায় মেতে উঠেছে।

 পৃথিবী আজ সজাগ হয়েছে। পৃথিবীর এই অষ্টম বৃহৎ রাষ্ট্র বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে আছে বিশ্বের মানুষ, যেখানে ওরা এ ধ্বংসের খেলায় মেতে উঠেছে। বিশ্বের মানুষ আজ আর ইসলামাবাদ সরকারের আইন-শৃঙখলা রক্ষার মিথ্যা যুক্তি আর অজুহাত স্বীকার করে নিতে রাজি নয়। যে সমস্ত সাংবাদিক বাংলাদেশের এই যুদ্ধের ভয়াবহতা ও নৃশংসতা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন তারা ইয়াহিয়ার এই অন্যায় ও অমানবিক যুদ্ধ আর ধ্বংসলীলার বিরুদ্ধে নিন্দা জানাচ্ছেন। অপরপক্ষে যে সমস্ত সাংবাদিক আমাদের মুক্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন তাঁরা বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন বাংলাদেশের মানুষের এই বীর প্রতিরোধ যুদ্ধের খবর-আর বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন ইয়াহিয়া সরকারের ধ্বংস ও তাণ্ডবলীলার চাক্ষুস প্রমাণ।

 ইতিমধ্যে সোভিয়েত রাশিয়া এবং ভারতবর্ষ এই নির্বিচার গনহত্যার বিরুদ্ধে তাঁদের হুঁশিয়ারী উচ্চারন করেছে এবং সোভিয়েত রাশিয়া অবিলম্বে এই হত্যাযজ্ঞ ও নিপীড়ন বন্ধ করবার আহ্বান জানিয়েছেন। গ্রেট ব্রিটেনও বাংলাদেশের এ অবস্থা সম্পর্কে সজাগ হয়ে উঠেছে। যে সমস্ত পাকিস্তানী বিমান মৃত্যুর সরঞ্জাম নিয়ে ঢাকা আসার পথে জ্বালানী সংগ্রহ করছিল তাদেরকে জ্বালানী সরবরাহ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র সিংহল ও ব্রহ্মদেশ।

 যদিও কোন কোন দেশ বাংলাদেশের ঘটনাবলীকে পাকিস্তানের আভ্যন্তরীন ব্যাপার বলে অভিহিত করছেন, তবু একথা এখন দিবালোকের মত সত্য হয়ে গেছে যে সাড়ে সাত কোটি মানুষকে পিষে মারার চেষ্টা, তাদের কষ্টার্জিত স্বাধীনতাকে ব্যর্থ করে দেবর ষড়যন্ত্র একটি আন্তর্জাতিক ব্যাপারে পরিগণিত হয়েছে এবং এই সমস্যা আজ পৃথিবীর সমস্ত মানুষের বিবেককে নাড়া দিচ্ছে। বাংলাদেশের সরকারের পক্ষ থেকে আমরা বিদেশে অবস্থানরত বাঙালী ভাইদের বাংলাদেশের পক্ষে জনমত সৃষ্টি ও পৃথিবীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে অনুরোধ জানিয়েছি। পৃথিবীর বিভিন্ন রাজধানীতে আমরা আমাদের প্রতিনিধি পাঠাচ্ছি এবং বিদেশের সমস্ত রাষ্ট্রের কাছে কূটনৈতিক স্বীকৃতি ও আমাদের স্বাধীনতা ও আত্মরক্ষার সংগ্রামে সাহায্য ও সহানুভূতি চেয়ে পাঠাচ্ছি।

 আমাদের যে সমস্ত ভাইবোন শত্রুকবলিত শহরগুলোতে মৃত্যু ও অসম্মানের নাগপাশে আবদ্ধ, আদিম নৃশংসতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে সাহস ও বিশ্বাসের সাথে মুক্তির পথ চেয়ে আছেন তাঁদেরকে আমরা এক মুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারি না। যাঁরা আমাদের সংগ্রামে শরিক হতে চান তাঁদের জন্যে রইল আমাদের আমন্ত্রণ যাঁদের পক্ষে নেহাৎই মুক্ত এলাকায় আসা সম্ভব নয় তাঁদেরকে আমরা আশ্বাস এবং প্রেরণা দিচ্ছি বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের পক্ষ থেকে, শহীদ ভাইবোনদের বিদেহী আত্মার পক্ষ থেকে। শহীদদের রক্ত বৃথা যেতে পারে না। ইনশাআল্লাহ, জয় আমাদের সুনিশ্চিত।

 আমাদের যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হবে না বলে আমাদের স্থিরবিশ্বাস; কারন প্রতিদিনই আমাদের শক্তি বৃদ্ধি হচ্ছে এবং আমাদের এ সংগ্রাম পৃথিবীর স্বীকৃতি পাচ্ছে। কিন্তু আমাদের মুক্তিবাহিনীর হাতে শেষ পরাজয় মেনে নেয়ার আগে শত্রুরা আরও অনেক রক্তক্ষয় আর ধ্বংসলীলা সৃষ্টি করবে। তাই পুরাতন পূর্ব পাকিস্তানের ধ্বংসাবশেষের ওপর নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলবার সংকল্পে আমাদের সবাইকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে। আমাদের এই পবিত্র দায়িত্ব পালনে এক মুহূর্তের জন্যেও ভুলে গেলে চলবে না যে এ যুদ্ধ গনযুদ্ধ এবং এর সত্যিকার অর্থে এ কথাই বলতে হয় যে এ যুদ্ধ বাংলাদেশের দুঃখী মানুষের যুদ্ধ। খেটে খাওয়া সাধারন কৃষক, শ্রমিক, মধ্যবিত্ত, ছাত্র-