পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৩৪৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
319

এই ঘটনার পর পাটেশ্বরী প্রতিরোধ ঘাঁটি ভেঙ্গে যায়। পাকিস্তানী সৈন্যরা নাগেশ্বরী থানা বাজারে ঢুকে সমগ্র বাজারে আগুন ধরিয়ে দেয়। বাজারে অবস্থানরত একজন পাগলকে দেখামাত্র সৈন্যরা তাকে গুলিবিদ্ধ করে হত্যা করে। হানাদার সৈন্যরা নাগেশ্বরী বাজারে প্রবেশের পরপরই রায়গঞ্জ সেতুর নিকট ডিফেন্সরত মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সরিয়ে নেয়া হয়। ভূরুঙ্গামারী থানার সাথে যোগাযোগ রক্ষাকারী রায়গঞ্জ বাজার সংলগ্ন বৃহৎ সেতুটি মুক্তিযোদ্ধারা ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয়।

 নাগেশ্বরী থানায় অবস্থান পাকাপোক্ত করার পর হানাদার সৈন্যরা ভূরুঙ্গামারী থানার দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। ইতিমধ্যে ভূরুঙ্গামারী থানা সদরে অবস্থিত গেরিলা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র বন্ধ করে দেয়া হয় এবং গেরিলা দফতর সীমান্তের ওপারে পশ্চিম বাংলার কুচবিহার জেলার সাহেবগঞ্জ বাজারে সরিয়ে নেয়া হয়। সেখানেই দ্রুত কয়েকটি অস্থায়ী গেরিলা ঘাঁটি গড়ে তোলা হয়। পরে গেরিলা যোদ্ধারা এই অস্থায়ী ঘাঁটিগুলো থেকে ভূরুঙ্গামারী থানা সদরে পার্শ্ববর্তী স্থানে অবস্থানরত হানাদার সৈন্যদের উপর অতর্কিত আক্রমণ শুরু করে।

 সুবেদার বোরহান তাঁর অধীনস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ভূরুঙ্গামারী থানার অন্তর্গত সাবেক রেলওয়ে স্টেশন সোনাহাটে চলে যান। পাকিস্তানী সৈন্যরা ভূরুঙ্গামারী থেকে সাবেক পাটেশ্বরী রেলওয়ে স্টেশনের নিকটবর্তী দুধকুমার নদীর উপর অবস্থিত পাটেশ্বরী রেলওয়ে ব্রীজ অতিক্রম করে সোনাহাটে যাতে পৌছতে না পারে সেজন্য পাটেশ্বরী ব্রীজের পূর্বতীরে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে মোতায়েন করা হয়।

 ১৫ই জুন সাহেবগঞ্জ অস্থায়ী ঘাঁটির গেরিলারা ভূরুঙ্গামারীর অদূরে বাংলাদেশ সীমান্তে অবস্থিত ই-পি- আর ফাঁড়িতে অবস্থানরত পাকসৈন্যদের উপর আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে বেশ কয়েকজন পাকসৈন্য নিহত হয়। গেরিলাদের পক্ষে মোট তিনজন নিহত হন। নিহত গেরিলারা হলেনঃ (১) সিপাহী আব্দুস সোবহান, ই-পি-আর নং-১৬০৭৪; (২) সিপাহী মনসুর আহমদ, ই-পি-আর নং-৫৮০৪; (৩) কুক আবু কালাম (ই-পি- আর)।

 ২৯শে জুন মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল মোগলহাটে অবস্থানরত পাকসৈন্যদের উপর হঠাৎ হামলা চালিয়ে বেশ কয়েকজনকে হতাহত করে। এখানে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল বারী নিহত হন। মুক্তিযোদ্ধারা হানাদার সৈন্যদের বেশ কিছু অস্ত্র দখল করতে সক্ষম হন।

 ১৪ই জুলাই বড়খাতায় অবস্থানরত পাকসৈন্যদের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে গেরিলারা ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে। মুক্তিযোদ্ধা সিপাহী মুহাম্মদ আলী (ই-পি-আর নং ৭২৯৬) হানাদার সৈন্যদের গুলিতে নিহত হন। বড়খাতায় হানাদার সৈন্যদের অবস্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের অপর আর একটি দল আক্রমণ চালায় ২৩শে জুলাই। সিপাহী আনোয়ার হোসেন, ই-পি-আর এই সংঘর্ষে নিহত হন।

 ভূরুঙ্গামারী থানা সদরে প্রবেশের পর পাকসৈন্যরা বাজার সংলগ্ন ভূরুঙ্গামারী কলেজে তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করেছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বিরাট দল ভারী অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ২রা আগস্ট হানাদার সৈন্যদের উক্ত অবস্থানের উপর প্রচণ্ড আঘাত হানে। এই সংঘর্ষে উভয় পক্ষই মেশিনগান ও কামান ব্যবহার করে। মুহুর্মুহু প্রচণ্ড কামানের শব্দে চারদিক প্রকম্পিত হতে থাকে। হানাদার সৈন্যরা তাদের অবস্থান থেকে সরে না গেলেও বহু হতাহত হয়। এই প্রচণ্ড যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা আনসার আলী নিহত এবং বেশকিছুসংখ্যক আহত হন। মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানী সৈন্যদের উপর চাপ অব্যাহত রাখেন। ১৩ই আগস্ট পুনরায় বুরুঙ্গামারী বাজারের সন্নিকট থেকে হানাদার সৈন্যদের উপর আক্রমণ চালানো হয়। এই আক্রমণ অল্প সময়ের মধ্যেই প্রচণ্ড সংঘর্ষের রূপ নেয়। সৈন্যরা ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে। মুক্তিযোদ্ধা সিপাহী কবির আহমদ, ই-পি-আর নিহত হন। এর পর থেকে আমাদের গেরিলা যোদ্ধাদের আক্রমণ ক্ষমতা বেড়ে যায়। ভারত থেকে আমরা পর্যাপ্ত গোলাবারুদ পাচ্ছিলাম। ভারী অস্ত্র চালনায় গেরিলা যোদ্ধারা বেশ দক্ষ হয়ে উঠছিল।