পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৪৬৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
438

থেকে গোলা নিক্ষেপ করে একটা গানবোট বিধ্বস্ত করে। গানবোটটি গুলি খেয়ে দক্ষিণ দিকে ৩ মাইল পর্যন্ত গিয়ে ডুবে যায়। পরবর্তীকালে পাঞ্জাবীদের ৪ টি মরা লাশ নদীতে ভাসতে দেখা যায়। বাদবাকি ৬ টি গানবোট থেকে খানসেনারা মর্টার, আর-আর, হেভী মেশিনগান, লাইট মেশিনগান থেকে আমাদের উপর প্রবলভাবে গোলাবর্ষণ করে এবং মুক্তিযোদ্ধারা তার পাল্টা জবাব দিতে থাকে। এমনি করে ভোর থেকে বিকেল ৪ টা পর্যন্ত ভীষণভাবে গোলাগুলি করেও পাড়ে উঠতে ব্যর্থ হয়ে তারা যে পথে এসেছিল সে পথে ফিরে চলে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা ত্যারাব্যাকা হাট নামক স্থানে একত্রিত হয় এবং কাজার থেকে চিড়া মুড়ি কিনে খাওয়া-দাওয়া করে। ক্যাপ্টেন জিয়া এবং আমি শরণখোলা রেঞ্জ অফিস এবং বগি ফরেস্ট অফিস ও শরণখোলা থানার দক্ষিণ অঞ্চলে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার জন্য ৫০জন সাহসী মুক্তিযোদ্ধাকে সশস্ত্রভাবে রেখে আমাদেরকে গন্তব্যস্থান ধানসাগরে চলে যাই। এই সময় তারা যেন কোন আক্রমণ না করে। পরবর্তীকালে বরিশাল জেলার বিভিন্ন থানাতে অপারেশন করার জন্য তাদের পাঠান হয়েছিল। তারা বীরত্বের সাথে সেসব জায়গায় অপারেশন করে এবং বহু রাজাকার ও খানসেনাকে হত্যা করে অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করতে সক্ষম হয়।

 ক্যাপ্টেন জিয়া পরবর্তীকালে মুক্তিযোদ্ধাদের একটা কনফারেন্স ডাকেন এবং সেখানে এই সিদ্ধান্ত হয় যে খুলনা, পটুয়াখালী, বরিশালের কলেজ এবং স্কুলে যেসব যুবক ছেলে আছে তাদেরকে সুন্দরবনে নিয়ে নতুন করে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং দিতে হবে। সেই অনুযায়ী ওখান থেকে ২০ মাইল দক্ষিণে হেলা নদী থেকে তাম্বল নদীতে ঢুকে তেতুলবাড়িয়া খাল দিয়ে উত্তর দিকে ঢুকে ছোট্ট খালের দুই পাশে সুন্দরী কাঠদিয়ে গোলপাতার ঘর করি। প্রতম অবস্থায় খুলনা জেলার মুক্তিযোদ্ধাদের হেডকোয়ার্টার এখানেই করা হয়।

 পরবর্তীকালে শরণখোলা থানার মুক্তিযোদ্ধাদের কমাণ্ডার নিযুক্ত করা হয় সুবেদার আজিজের পরিবর্তে সুবেদার গফ্ফারকে। কারণ আজিজ (ফুলুমিয়া) ছিল অত্যন্ত অত্যাচারী। বিনা অন্যায়ে নিজের ইচ্ছামত অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে গুলি করে মেরেছে এবং সাধারণ মানুষের উপর অনেক অন্যায়-অত্যাচার করেছে। ক্যাপ্টেন জিয়া সুবেদার আজিজকে বন্দী করে ভারত পাঠিয়ে দেন। অন্যদিকে ক্যাপ্টেন জিয়া তাম্বুলবুনিয়া নদীর দুই পার্শ্বে ছোট খালগুলির মধ্যে অনেক ঘর তৈরী করার নির্দেশ দিলেন। এক এক গ্রুপের জন্য এক এক জায়গায় ব্যবস্থা করলেন। তাম্বুলবুনিয়া খালের পূর্বদিকে একটি খালে তিনি ছাত্রদের জন্য একটি ক্যাম্প তৈরী করেন। সেখানে অনেক জায়গা নিয়ে ট্রেনিং দেবার জন্য সুন্দরীগাছ কেটে একটি খোলা মাঠ তৈরী করলেন। সেই মাঠে বাংলাদেশী জাতীয় পতাকা তোলা হতো এবং যুবকদের রীতিমত সামরিক কায়দায় ট্রেনিং দেয়া হত। উক্ত ছাত্রদের ক্যাম্পের দায়িত্ব হয়েছিল পরিতোষ কুমার ও লিয়াকত আলী খানের উপরে। একদিকে শারীরিক পরিশ্রম করে ট্রেনিং দেয়া হত, অন্যদিকে গেরিলা যুদ্ধ সম্পর্কে ক্লাস নেয়া হতো। সময় সময় সামরিক কায়দায় শারীরিক পানিশমেণ্ট দেয়া হতো। উক্ত ছাত্রদের ক্যাম্পের সুন্দরী গাছ কেটে অনেক জায়গা নিয়ে পুকুর কাটা হয়েছে। টিনের দোচালা ঘর করা হয়েছিল। আসামীদের রাখার জন্য জেলখানা রাখা হয়েছে। খাদ্য রাখার জন্য গোডাউন ঘর করা হয়েছিল। আসামীদের দেখাশুনার জন্য জেলের কর্মকর্তা এবং স্টাফ নিযুক্ত করা হয়েছিল। ছাত্রদের ক্যাম্পে বিশ খানার মত বড় এবং ছোট নৌকা রাখা হয়েছিল। মাঝে মাঝে ক্যাপ্টেন জিয়া এবং আমি অতর্কিতে দেখাশুনার জন্য ক্যাম্প ভিজিট করতাম। তাম্বুলবুনিয়া নদীর পার্শ্বে তেতুলবাড়িয়া হতে হেডকোয়ার্টার নিয়ে আসা হয়। সেখানে নানা প্রকার ঘর করা হলোঃ

 (ক) খুলনা জেলা কমাণ্ডিং অফিসের জন্য অফিস ঘর তৈরী করা হলো। সেখানে সামরিক কায়দায় সব প্রস্তুতি নেয়া হল।

 (খ) সহকারী অধিনায়কের জন্য অফিস করা হলে এবং টাইপিস্ট ইত্যাদির ব্যবস্থা করা হলো।

 (গ) প্যারেড মাঠ তৈরী করা হলো। সেখানে যোদ্ধাদের একত্রিত করা এবং অপারেশন যাবার পূর্বে সব ফল-ইন- করিয়ে চারদিকে পাঠান হতো।