পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৪৯৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
473

একশ গজ পিছিয়ে ছিলেন। এর মধ্যেই আরটিলারী ফায়ার শুরু হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন কামালপুর ক্যাম্পের ভিতরে চলে যান এবং আরটিলারী ফায়ার বন্ধ করতে পারেন। ওদিকে ক্যাপ্টেন হাফিজ আরটিলারীকে একশগজ আগের ফায়ার দিতে বলেন এবং আরটিলারী অফিসার ক্যাপ্টেন হাফিজ সাহেবের সিগনাল ও গোলা বর্ষণ করেন। ফলে সালাউদ্দীন কোম্পানীর বেশ কিছু ছেলে হতাহত হন এবং ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন স্বয়ং আঘাতপ্রাপ্ত হন। তবুও তিনি দমেননি। শত্রুদের অনেকেই মারা পড়ছিল এবং কেউ কেউ পালাতে চেষ্টা করছিল ও একজন পালিয়েও ছিল। ইতিমধ্যেই শত্রুপক্ষের মেশিনগান ফায়ার পশ্চিম দিক থেকে অর্থাৎ কামালপুর পোস্ট অফিস ও গোডাউনের মাঝামাঝি থেকে সালাউদ্দীন কোম্পানীর দিকে আসতে থাকে। দুর্ধর্ষ সৈনিক সালাউদ্দীন ভেবেছিলেন ঐ এম-জিটাকে স্তব্ধ করে দিতে পারলেই বিখ্যাত কামালপুর দখলে আসবে এবং এই ভেবে তিনি একাই গিয়েছিলেন সেই এম-জিটাকে মারতে। তিনি যখন গোডাউনের কাছ থেকে ফায়ার করবেন, ঠিক সেই সময়েই পোস্ট অফিসের দিক থেকে একটি এল-এম-জি হঠাৎ গর্জে উঠলো এবং বাংলার বীর সন্তান ক্যাপ্টেন সালাউদ্দীনের বুক ঝাঁঝরা করে দিয়ে গেল। ক্যাপ্টেন সালাউদ্দীন বীরের মত শহীদ হলেন। তাঁর মৃতদেহ আনা সম্ভব হয়নি এবং তার মৃতদেহ আনতে গিয়ে ১৭জন বেঙ্গল রেজিমেণ্ট সৈন্য আহত হয়েছিলেন। পরে শোনা গেছে শহীদ সালাউদ্দীনের লাশ পাক সেনারা সামরিক কায়দায় সমাধিস্থ করেছে।

 সেদিন এই মর্মন্তদ যুদ্ধে শুধু ক্যাপ্টেন সালাউদ্দীন শহীদ হননি, আরও দু'জন জুনিয়র অফিসার, ক্যাপ্টেন হাফিজ ও লেঃ মান্নান গুরুতরভাবে আহত হন এবং আরও তিনজন জুনিয়র কমিশণ্ড অফিসার আহত হন। সেদিনের আক্রমণে মুক্তিবাহিনীর পক্ষে বেঙ্গল রেজিমেণ্টসহ মোট ৬১জন সৈন্য বীরের মত শহীদ হন। অপরদিকে পাকবাহিনী হারায় একজন অফিসারসহ মোট ৭০ জন সৈন্য। সেদিন কামালপুর দখল করা সম্ভব হয়নি।

 তারপর অমিতবিক্রমে কামালপুর আক্রমণ করা হয়েছিল। সেদিন ছিল ৯ই আগস্ট। এই আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধাদের ভুমিকাই বেশী। তাছাড়া বেঙ্গল রেজিমেণ্টের কিছু সৈন্যও ছিল। ৯ই আগষ্ট রাত ৮-৩০ মিনিটে হেলাল কোম্পানীর ৩৭জন ছেলে বক্সিগঞ্জ-কামালপুর সড়কে এ্যামবুশ নিয়ে থাকে এবং তারা টেলিফোনের তার কেটে দিয়ে পাক বাহিনীর তার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এই দলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা কমাণ্ডার হেলাল। সেই রাত্রিটি ছিল মেঘাচ্ছন্ন, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল।

 এই এ্যামবুশে থাকাকালীন বক্সিগঞ্জ থেকে কামালপুর গমনরত দু'জন রাজাকারকে এইদল গ্রেফতার করে দুটি রাইফেল ও ১০ রাউণ্ড গুলি উদ্ধার করে। এদের কে মহেন্দ্রগঞ্জে ক্যাম্পে পাঠিয়ে দিয়ে এই দল এখানেই এ্যামবুশে থাকে। কিছুক্ষণ এখানে এ্যামবুশে থাকার পর এই দলের টু-আই-সি বিচক্ষন লতা দেখতে পেল তাদের পজিশন থেকে দশ হাত দূরে দুজন রাজাকারসহ পাকবাহিনীর বিরাট বাহিনী পজিশন নিচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে লতা দিক নির্দেশ করে ফায়ার- এর আদেশ দিল। ফলে পাক দস্যুরা আর পজিশন নিতে পারেনি। ৭টা এস-এল-আর ও একটি এল-এম-জি দিয়ে বৃষ্টির মত গুলি ছুড়লো হেলাল-লতার দল। গুলির আঘাতে পাকবাহিনী দলের কমাণ্ডার আহত হয়ে গেল, তারপর অকথ্য মুক্তিবাহিনীর দলকে গালাগালি করতে লাগলো। ওরা সার্চ শুরু করলো। ততক্ষণে হেলাল কোম্পানীর দল ওখান থেকে উইথড্র করে চলে এসেছে। কিন্তু সবাই বিচ্ছিন্ন অবস্থায়। সবাইকে পাওয়া গেল কিন্তু লতা ও আর একটি ছেলেকে হেলাল খুঁজে পেল না। পরে ওরা রাত ১২টার সময় নির্দিষ্ট স্থানে এলো এবং খবর দিল একজন কর্নেল আহত ও ৪৭ জন পাক সৈন্য খতম হয়েছে। এই দুর্ধর্ষ আক্রমণে হেলালের কৃতিত্বের জন্য ওর কোম্পানীর নাম সেদিন টাইগার দেওয়া হয়েছিল। তারপর মেজর তাহের আগস্ট মাসের ১১ তারিখে মহেন্দ্রগঞ্জে ১১ নং সেক্টর পরিদর্শনে আসেন।

 মুক্তিযোদ্ধা কমাণ্ডার হেলাল লেঃ কর্নেল তাহেরের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে কামালপুর রণাঙ্গনে অভুতপূর্ব কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। ২৬শে অক্টোবর এক সময়ে তিনি তার দল সহকারে কর্নেল তাহেরের নির্দেশে কামালপুরের পেছনে গেদ্দা ও উঠানুরপাড়ায় পর পর তিনদিন এ্যামবুশে থেকে বিস্ফোরণ ঘটানোর কাজ করেন।