বিষয়বস্তুতে চলুন

পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৫১৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: দশম খণ্ড
488

যাচ্ছি। শেষবারের মত টেনে-হেঁচড়ে বিক্ষত দেহটাকে আর্টিলারী শেলে সৃষ্ট একটি কালো মাটির গর্তে নিয়ে গেলাম। শত্রু যাতে সহজে দেখতে না পায়-গলা পর্যন্ত ধীরে ধীরে বাঁ হাতের কর্দমাক্ত কালো মাটি দিয়ে লেপে দিয়ে স্টীল হেলমেট মাথার নীচে দিয়ে শুয়ে রইলাম। অপেক্ষায় রইলাম চরম মুহূর্তের, চোখ আপনা থেকেই বুজে আসছে, স্টেনটা বাঁ হাতে ধরা। বন্দী হবো না কোন ক্রমেই, বরং মেরে মরব। তবুও মনেপ্রাণে মরার কথাটা চিন্তা করতে পারছিলাম না। কেন জানি মনে হচ্ছিল এত অল্প বয়সে মরে যাব। চোখ দুটোকে আর খুলে রাখতে পারছিলাম না। ঠিক সময় আমার কমাণ্ডিং অফিসার মেজর আমিনের কণ্ঠস্বর ভেসে আসলো শালবন থেকে-“আমিন, আস্তে আস্তে আসার চেষ্টা কর।” আহত হওয়ার তিনঘণ্টা পর এই প্রথমবারের মত সক্রিয় সাহায্য পেলাম। বস্তুত, আমার নিহত বা নিখোঁজ হওয়ার সংবাদে কর্নেল জিয়াউর রহমানের নির্দেশে মেজর আমিন তখন কমাণ্ডো প্লাটুন নিয়ে আমার মৃতদেহ খুঁজতে বের হয়েছিলেন। আমার কাছে ক্রল করে আসতে ইতস্তত করছিল দেখে মেজর আমিন নিজেই খালি হাতে ক্রল শুরু করলেন। সাথে সাথে হাবিলদার তাহের মেজর আমিনের পিছু নিল। আমার কাছে এসে উভয়ে পর্যায়ক্রমে আমার পা ধরে মৃতদেহের মত টানতে শুরু করলো। পিঠের চামড়া উঠে যাচ্ছে, বিক্ষত ডান পায়ের ব্যাথার ডুকরে উঠলেও দাঁত কামড়ে রইলাম। সম্ভবতঃ আনন্দের আতিশয্যে ব্যথা ভুলেও গেলাম, লেফটেন্যাণ্ট মোদাসসের তখন চিৎকার করছে শালবন থেকে-‘তাড়াতাড়ি করেন স্যার।' তার দুই এল-এম-জি-ওয়ালাকে হত্যা করে পায়ে পায়ে এগুচ্ছে। আমাদের দুই এল-এম-জি, ওয়ালা কেঁদে কেঁদে বলছে-“আপনাদের ধরে ফেললো যে স্যার।” দাঁত খিঁচিয়ে আমরা বললাম-“বেটা ফায়ার কর।” আমাদের উপর দিয়ে ফায়ার করতে হবে তাই জোয়ানরা ইতস্তত করছিল। শত্রুতখন আমাদের উপর চার্জ করে আর কি! সংগে সংগে এল-এম-জি গর্জে উঠলো। ৬/৭টি খান সেনা তৎক্ষণাৎ লুটিয়ে পড়লো। মকবুল আর তার সাথী দালালকে আমরা হাতেনাথে ধরে ফেললাম। দুটি খানসেনা পালিয়ে বাঁচলো। কিন্তু সংগে সংগে শত্রুর আর্টিলারী ফায়ার এসে পড়তে লাগলো। বৃষ্টির মত 'আর্টিলারী ফায়ারের মাঝে মেজর আমিন আমাকে কাঁধে নিতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু পরিশ্রান্ত মেজর আমিন নিজেই আমাকে নিয়ে নালায় পড়ে গেলেন। “স্যার প্লীজ আপনি চলে যান, তাহের আমাকে নিয়ে আসবে” আমি বলে উঠলাম। শেষ পর্যন্ত জোর করে আমি তাহেরের দিকে হাত বাড়ালাম। “স্যার প্লীজ আপনি চলে যান”, আবার বললাম। আর বৃষ্টির মত আর্টিলারী ফায়ারের মধ্যে হাবিলদার তাহের আমাকে কাঁধে নিয়ে দিল এক ভোঁ দৌড়। ভীষণভাবে হাঁপাচ্ছিল তাহের। হাঁপাতে হাঁপাতে বলছে, “স্যার চিন্তা করবেন না, মরলে দু'জন একসাথেই মরব।”

 নকশী বি-ও-পি আক্রমণকালে যারা শহীদ বা নিখোঁজ হয়েছেন তাঁরা হলেনঃ ১। হাবিলদার নাসিরউদ্দিন ২। সিপাই মোহাম্মদ আলী ৩। সিপাই সিরাজুল হক ৪। ল্যাঃ নাঃ আবুল কালাম ৫। ল্যাঃ নাঃ মোঃ ইউসুফ মিয়া ৬। সিপাই হুমায়ন কবীর ৭। সিপাই মোঃ সুজা মিয়া ৮। সিপাই শামসুজ্জামান ৯। সিপাই আবদুস সাত্তার ১০। সিপাই ফয়েজ আহমদ ১১। সিপাই আবদুস সালাম ১২। সিপাই মোঃ হানিফ, এক্স ই- পি-আর ১৩। সিপাই আবদুস সালাম ১৪। সিপাই সদর উদ্দিন ১৫। সিপাই ফজলুল হক ১৬। সিপাই আবদুস সামাদ ১৭। সিপাই জামাল হোসেন ১৮। সিপাই আবু ইসমাইল ১৯। নায়েক আবদুস সালাম ২০। নায়েক সৈয়দ ফুল মিয়া ২১। নায়েক সতর উদ্দিন ২২। নায়েক হায়েত আলী ২৩। নায়েক আবদুল কুদ্দুস ২৪। রবিউল আলম ২৫। সিপাই শাহজাহান আলী ২৬। সিপাই মনসুর আলী।

 ৩১শে জুলাই ৭১ কামালপুর যুদ্ধে নিহত কিংবা নিখোঁজদের তালিকাঃ ১। ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ ২। সিপাই মোহাম্মদ আলী ৩। ল্যান্স নায়েক গোলাম মোস্তফা ৪। সিপাই মতিউর রহমান ৫। সিপাই রহিতুল্লাহ ৬। সিপাই আমিনুল ইসলাম ৭। সিপাই আবদুল লতিফ ৮। সিপাই রবিউল ইসলাম ৯। সিপাই রফিকুল ইসলাম ১০। সিপাই আবদুল ওয়াহাব ১১। সিপাই সদরউদ্দিন ১২। ল্যাঃ নায়েক সিরাজুল ইসলাম ১৩। সিপাই মোস্তফা কামাল ১৪। আনোয়ার হোসেন ১৫। আবদুস সোবহান।