পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দ্বাদশ খণ্ড).pdf/২৭৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংরাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ দ্বাদশ খণ্ড
২৪৯

 আমাদের ভারতবর্ষের ব্যবস্থা সম্বন্ধে অনেক বক্তা বলেছেন যে, এখানে ফ্যাসিজম রয়েছে, গণতন্ত্র নেই। আমি বলব তাঁরা বাস্তব অবস্থার ভিত্তিতে কথা বলেছেন না। মুজিবুর বাংলাদেশে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিলেন, তিনি আশা করেছিলেন যে, সামরিক সরকার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবেন। মুজিবুর বাংলাদেশে প্রথমে স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি, সশস্ত্র বিপ্লবের পথ নেননি। ২৫শে মার্চ যখন মুজিবুরের দলকে বেআইনী ঘোষণা করা হল, মুজিবুরকে দেশদ্রোহী বলা হল তারপর মুজিবুর সশস্ত্র সংগ্রামের কথা বললেন। সুতরাং মুজিবুরের আন্দোলন থেকে একথা আসে যে, সশস্ত্র সংগ্রাম ছাড়া কোন পথ নেই, সশস্ত্র সংগ্রাম ছাড়া গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। মুজিবুর প্রথমে অসহযোগ আন্দোলন করেছিলেন এবং আশা করেছিলেন যে, এই অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে গণতন্ত্র স্থাপিত হবে।

 আমাদের এই ভারতবর্ষে চতুর্থ সাধারণ নির্বচনের পর এই বাংলাদেশে কংগ্রেস সরকার পরাজিত হয়েছিলেন এবং যুক্ত ফ্রণ্ট সরকার গঠন করেছিলেন। তার জন্য কোন সশস্ত্র অভ্যুত্থানের দরকার হয়নি, সেটা সংবিধানের ভেতর দিয়েই হয়েছিল। সেই যুক্তফ্রণ্ট সরকার যখন এলেন তখন তাঁদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল, তাঁদের সংখ্যা ছিল ২১৮। এত বড় সংখ্যাগরিষ্ঠতা কোন সরকারের ছিল না। এই যুক্তফ্রণ্ট সরকার যখন এলেন তখন কংগ্রেস দল তাঁদের কোন বাধা দেয়নি, কোন রক্তপাত হয়নি, বোমা, পিস্তল ছোঁড়া হয়নি।

 এবারেও পশ্চিমবঙ্গ সরকার এলেন গণতান্ত্রিক পথে। সুতরাং আজকে এই যে, গণতন্ত্র হত্যার কথা উঠেছে সেই হত্যা কারা করছে সেটা একটু অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে বিবেচনা করুন, বাস্তব অবস্থার দিকে তাকিয়ে দেখুন।

 অত্যন্ত দুঃখের কথা এই যে, এই প্রস্তাব সমর্থনের ভিত্তিতে সরকারের বিরুদ্ধে আক্রমণ হয়েছে। আমরা আশা করেছিলাম প্রস্তাবটা সর্ববাদীসম্মতভাবে এসেছে, এর ভেতর কোন বিভেদ, আক্রমণ, সমালোচনা থাকবে না। কিন্তু আমরা দেখতে পেলাম বাংলাদেশের কথা ছেড়ে অনেক কথা এখানে হয়ে গেল। সুতরাং এই যে বাংলাদেশ, এই বাংলাদেশের কথাই আমি বলতে চাই। এই বাংলাদেশের গণহত্যা বন্ধ করার জন্য এই সভা যে প্রস্তাব এনেছে তাকে সমর্থন করে আমি একথা বলতে চাই যে, এই গণহত্যাকে ধিক্কার দেওয়া হয়েছিল রাষ্ট্রসংঘে ৯ই ডিসেম্বর ১৯৪৮ সালে। তখন রাষ্ট্রসংঘে একটা প্রস্তাব আনা হয়েছিল গণহত্যাকে বেআইনী ঘোষণা করে এবং তাতে একথাও বলা হয়েছিল যে, দেশে গণহত্যা চলবে রাষ্ট্রসংঘের অধিকার থাকবে সে দেশের গণহত্যা বন্ধ করবার জন্য ব্যবস্থা নেওয়ার এবং সে প্রস্তাব যখন পেশ করা হয়েছিল তখন পাকিস্তানের যে সদস্য ছিলেন তিনি সেই প্রস্তাব বিশেষভাবে সমর্থন করেছিলেন এবং রাষ্ট্রসংঘের সেদিনের সভায় তিনি অনেক করতালি পেয়েছিলেন। সুতরাং পাকিস্তান বলছে যে, বাংলাদেশে যে জেনোসাইড চলছে, যে গণহত্যা চলছে তাতে রাষ্ট্রসংঘের কোন একতিয়ার নেই হস্তক্ষেপ করার সেটা তার স্ববিরোধী। রাষ্ট্রসংঘের চ্যাপটার-সেভেনে আছে যে, সেখানে যুদ্ধের আশংকা রয়েছে, শান্তি বিঘ্নিত হবার আশংকা রয়েছে, সেখানে রাষ্ট্রসংঘ ব্যবস্থা নিতে পারেন। সুতরাং আমরা আশা করি রাষ্ট্রসংঘ দেরীতে হলেও এ ব্যাপারের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন। আমরা আরও আশা করি যে, ভারত সরকার তাদের স্বীকৃতি দেবেন। দুঃখের বিষয়, লালচীন যে পিপল ও লিবারেশনের কথা বলে তারা বাংলাদেশের পিপলের লিবারেশনের জন্য বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির জন্য একবারও এগিয়ে এলেন না।

 শ্রীরাম চ্যাটার্জিঃ স্পীকার মহাশয়, আজ বাংলাদেশে পূর্ব বাংলায় যে স্বাধীনতা সংগ্রাম সেই মুক্তি সংগ্রামকে পুরোপুরি সমর্থন করতে গিয়ে গোটাকতক কথা বলবো। পূর্ব বাংলা আমার রক্ত আমার খুন, আমার প্রাণের বাংলা। সেখানে বাঙ্গালী লড়ছে, তারা মরছে, তারা মাথা নত করছে না মুক্তির জন্য। নাড়ীর যোগ আছে, রক্তের যোগ আছে তাদের সাথে। সাথে সাথে আছে নাড়ীর সম্বন্ধ। ওই যে পূর্ব বাংলার মানুষ করাচীর একটা কলোনীতে পরিণত হয়েছিল, ব্যাথায় ব্যাথায় মানুষ সেখানে নিষ্পেষিত হচ্ছিল। বলবো, হে পূর্ব বাংলার মানুষ, সমব্যথী হিসাবে এখানকার এই পশ্চিম বাংলার মানুষ দিল্লীর কলোনীতে পরিণত হয়েছে। পাঁচ শত কোটি টাকা এখান থেকে সমস্ত নিয়ে যাচ্ছে, মাত্র ৫০ কোটি টাকা দিয়ে দিচ্ছে। আর আমরা চাতক পাখির মতো, ‘হা, হ, হা’ করে চেয়ে থাকি। আমাদের আকাশে বাতাসে কি দেখি? আমরা প্রতিনিধি হয়ে এসছি, যখন নির্বাচিত হয়ে