পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দ্বাদশ খণ্ড).pdf/২৮৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংরাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ দ্বাদশ খণ্ড
২৫৭

 শ্রী হরেকৃষ্ণ কোনারঃ মাননীয় উপাধাক্ষ মহাশয়, বাংলাদেশের মানুষ লড়ছে। তারা তাদের বুকের রক্ত ঝরাচ্ছে। আমাদের কর্তব্য হল একে শুধু সমর্থন করা নয়, একে আমরা কি করে শক্তিশালী করতে পারি, তাদের জয়ের পথকে কিভাবে সুগম করে তুলতে পারি, তার ব্যবস্থা করা।

 মাননীয় উপাধ্যক্ষ মহাশয়, এখানের খবরের কাগজগুলি পড়লে মনে হয় বাংলাদেশের মানুষের জন্য আমাদের এখানে প্রায় চোখের জলের এক প্রতিযোগিতা চলেছে। তার দাম আছে। যে মানুষ লড়ছে তার জন্য কিছু করতে না পেরেও যদি কাঁদতে পারা যায় তারও মূল্য আছে। কিন্তু আমাদের সীমান্তের ওপারে আমাদের ঘরের কাছে মানুষ যখন রক্ত দিচ্ছে তখন শুধু কান্নার প্রতিযোগিতা করে বাংলাদেশের মানুষের প্রতি কর্তব্য পালন করা ডাবে না। সেজন্য আমাদের কয়েকটি কর্তব্য আছে। সেই কর্তব্য দু’রকম- এক রকম বাংলাদেশের মানুষের লড়াইকে ভেঙ্গে চুরমার করে দেবার অজুহাত হিসাবে পাকিস্তানের শাসকচক্র শুধু মিথ্যা প্রচার করে চলেছে। এ কথা বললে ভুল হবে, নিজের মনকে ভুল বোঝান হবে- যদি মনে করি যে, পৃথিবীর কোথাও কোন মানুষকে তারা ভুল বোঝাতে পারছে না- এ কথা আমাদের বোঝা দরকার। একটা দেশের মানুষ লড়ছে, তাদের এই লড়াই-এর দাবী যুক্তিসংগত, এছাড়া তাদের পথ ছিল না, এটা যদি দুনিয়ার মানুষকে বোঝান যায়, তাদের সমর্থন যদি টানা যায়, তাহলে অনেক কাজ হবে। শুধু আমাদের মানুষের সমর্থন নয়পশ্চিম পাকিস্তান বলে যে জায়গা আছে, সেখানে যে মানুষ আছে, যদি সেখানকার মানুষের সমর্থন আদায় না করা যায়, তা হলে বাংলাদেশের মানুষের পক্ষে লড়াই করা আর একটু কষ্টকর হবে। তারা পারবে না আমি সে কথা বলছি না। কিন্তু যদি পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষদেরও বোঝানো যায় এবং তাদের সমর্থন পাওয়া যায় তাহলে পাকিস্তানের সামরিক শাসকচক্রকে আরও বেকায়দায় ফেলা যায় এবং তার ফলে বাংলাদেশের জনগণের সাহায্য হয়। যেমন করে ভিয়েতনামের লড়াইকে আমেরিকার অভ্যন্তরে সেখানকার ছাত্ররা এবং যুবকরা যুদ্ধের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখায়, তারা ভিয়েতনামের মানুষদের এইভাবে সাহায্য করে। তাই বারে বারে ভিয়েতনামের জনগণের নেতা কমরেড হোচিমিন আমেরিকার জনগণকে অভিনন্দন জানিয়েছেন, তাদের যারা ভিয়েতনামের সমর্থনে আমেরিকার সরকারের বিরুদ্ধে চাপ সৃষ্টি করেছেন। এমনিভাবে বাংলাদেশের পক্ষেও প্রয়োজন আছে যাতে পাকিস্তানের সামরিক চক্র সাধারণ মানুষকে ভুল বোঝাতে না পারে। তা ছাড়া পৃথিবীর অন্যান্য দেশও আছে, সেখানের জনগণেরও সমর্থন প্রয়োজন। সেই জন্য আমাদের একটা কর্তব্য হচ্ছে এই যে, বাংলাদেশের সংগ্রামের তাৎপর্য সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরা। আমরা ভারতবর্ষের মানুষ কেন সমর্থন করছি সে সম্বন্ধেও স্পষ্ট ধারণা থাকা দরকার। কারণ পাকিস্তানের সামরিক শাসনচক্র দুনিয়াকে ভুল বোঝাবার চেষ্টা করছে যে, আমাদের যে সমর্থন এটা বাংলাদেশের মানুষ যার জন্য লড়ছে, অর্থাৎ তাদের স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্র আমাদের দরদ তার জন্য নয় এরা ভারতবর্ষের লোক পাকিস্তান বিরোধী মনোভাব থেকে সমর্থন করছে, পাকিস্তান ভেঙ্গে গেলে ভারতের সুবিধা হতে পারে, এই রকম একটা মনোভাব থেকে সমর্থন করছে। এটা কিন্তু বোঝাবার চেষ্টা করা হচ্ছে। এটা যদি পাক সামরিক চক্র বোঝাতে পারে তাহলে স্বভাবতই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের লোক কিছুটা বিভ্রান্ত হতে পারে এই ভেবে যে, একটা দেশ টুকরো টুকরো হয়ে যাবে, আলাদা হয়ে যাবে, এবং তার গভর্নমেণ্টের পক্ষে তা মেনে নেওয়া মুশকিল। শুধু তাই নয়, আমাদের ভারতবর্ষের মধ্যেও বহু জাতির মানুষ আছে, বহু ধর্মের মানুষ আছে এবং তাদের সকলের ঐক্যেরও প্রয়োজন আছে। যদি পাকিস্তানের সামরিক চক্র এই কথা ভালভাবে প্রচার করতে পারে যে, একটা দেশকে টুকরো টুকরো করে দেবার জন্য বাংলাদেশের এই লড়াই তাহলে কি আমরা জোর করে বলতে পারি যে, আমাদের ভারতবর্ষের কোন অংশের মানুষের মনে কোন বিভ্রান্তির সৃষ্টি করতে পারে না? যদি তারা বোঝাতে পারে যে, এই সংগ্রাম পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষের বিরুদ্ধে বাঙ্গালীদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম, এই বোঝাতে পারে,ভুল বোঝাতে পারে, তাহলে কি ওদের সংগ্রামকে দুর্বল করতে পারা যায় না? আমি এই কথাটার উপর জোর দিতে চাই যে, বাংলাদেশের মানুষেরা পাকিস্তানকে ভেঙ্গে দেবার জন্য লড়াই শুরু করেনি। তারা চেয়েছিল গণতন্ত্র ও স্বায়ত্ত্বশাসন। এই প্রসঙ্গে বলতে পারি যে, যদি কোন দেশের রাষ্ট্রশক্তি ইতিহাসে এক বিশেষ শিক্ষাকে গ্রহণ না করেন তাহলে তিনি নিজে ভুল করবেন। বক্তৃতা দিয়ে অন্য কিছু করা যায় না। সেই শিক্ষা হল যে, যদি কোন