পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দ্বাদশ খণ্ড).pdf/৪০৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংরাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ দ্বাদশ খণ্ড
৩৭৯

পাকিস্তান থেকে স্বতন্ত্র ও সার্বভৌম রাষ্ট্ররূপে বিচ্ছিন্ন হলে পশ্চিম পাকিস্তানের আর্থিক সামরিক ও রাজনৈতিক ভিত্তির উপরে যে প্রচণ্ড আঘাত পড়বে এবং তার পরিণামে পাকিস্তানে যে অনিবার্য ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে তার গতিও হবে সুদূর প্রসারী।

 ১১। দ্বিজাতিতত্ত্বের বিষ ভারত ভাগের পরেও বিচ্ছিন্ন ভূ-খণ্ডের জনজীবনকে মর্মান্তিকভাবে বিষাক্ত করে রেখেছে। লক্ষ লক্ষ নর-নারী ও শিশুর অশ্রুজলেও এই নিত্য স্বাক্ষর নিশ্চিহ্ন হয়নি। বিধাতার এক মহান আর্শবাদরূপে বাংলাদেশে যে নতুন জাতীয়তাবাদের আহ্বান দিয়েছে -সেই ঐতিহাসিক ডাক সফল হলে ভারতীয় উপ-মহাদেশ এই প্রাণক্ষয়ী বিষের প্রকোপ থেকে মুক্ত হবে।

শরণার্থী

 ১২। বাংলাদেশের স্বদেশ বিতাড়িত গৃহচ্যুতরা অধিকাংশই হিন্দু- সংগ্রাম দীর্ঘায়িত হলে এদের সংখ্যা এক কোটির মাত্রা ছাড়িয়ে যাবে। এখনও এদের পরিচয় বাঙালীরূপে এবং এরা স্বগৃহে প্রত্যাবর্তনে ইচ্ছুক। কিন্তু দীর্ঘদিন শরনার্থী শিবিরে থাকলে এই গৃহচ্যুতের দল পূর্বাগত উদ্বাস্তুর দলে পরিণত হবে। এই শরণার্থীর অবিরাম আগমন পূর্বাঞ্চল ভারতের সামাজিক, আর্থিক ও শাসনতান্ত্রিক কাঠামো ভেঙ্গে ফেলবে এবং পূর্বাঞ্চল ভারতের দেশরক্ষা ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে বিপন্ন করে তুলবে। ভারতের আর্থিক কাঠামোর উপরেই যে এই শরণার্থীরা প্রচণ্ড আঘাত হানবে তাই নয়- ভবিষ্যতে শরণার্থীর সমস্যা মুখ্য সংকট সৃষ্টি করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সমর্থনের কর্তব্যকে গৌণ করে তুলবে।

 ১৩। বাংলাদেশের স্বদেশ-প্রেমিক মানুষ আজ ভারতের উপরে গভীরভাবে নির্ভরশীল। দীর্ঘায়িত সংগ্রামের পরিস্থিতি এবং পিণ্ডিশাহীর বর্বর অভিযানে বাংলাদেশের মানুষ ভারতের উপরে বিশ্বাস হারিয়ে হয়তো চীনমুখী হয়ে যাবে। ভারতের বন্ধুত্বে বিশ্বাসী মৌলানা ভাসানীকে ভারতের প্রত্যঘাতেই যে পিকিংপন্থী করে তুলেছে- সেই ঘটনাও অজানা নয়। এরূপ পরিবর্তন ঘটলে বাংলাদেশ সম্বন্ধে চীনা নীতির আমূল পরিবর্তনেও যে বিল্পব ঘটবে না, তা বলা যায় না।

গেরিলা যুদ্ধ

 ১৪। বাংলাদেশের দীর্ঘায়িত গেরিলা সংগ্রামের ভবিষ্যৎ কি হতে পারে? গেরিলা যুদ্ধের সাফল্যের প্রধান উৎস রাজনৈতিক নেতৃত্ব। এই নেতৃত্বদানের মানসিক প্রস্তুতি আওয়ামী লীগের নেই। আওয়ামী লীগের মানসিক গঠন ও সংগ্রামের প্রস্তুতি ছিল পাক-স্বাধীনতা যুগের কংগ্রেসের ন্যায়। তাই আওয়ামী লীগ পরিকল্পনা করেছিল গান্ধীপন্থি অসহযোগ আইন অমান্যের। এই সংগঠাত্মক বৈপ্লবিক মানসিকতার রূপান্তরিত করার জন্য নেতাজী সুভাসচন্দ্রের ন্যায় নেতৃত্ব এদের মধ্যে নেই। উপরন্ত বাংলাদেশের অভ্যন্তর থেকে আওয়ামী লীগের কর্মী ও নেতাদের গেরিলা সংগ্রাম পরিচালনার সম্ভাবনা পিণ্ডিশাহী চরমভাবে দূরূহ করে তুলেছে। তাই অধিকাংশ আওয়ামী লীগের নেতা ও কর্মী আজ দেশ ত্যাগী হতে বাধ্য হয়েছে। এরূপ পরিস্থিতিতে গেরিলা র সংগ্রাম দীর্ঘায়িত হলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব বদল এবং ভারতবিরোধী নেতৃত্বের আবির্ভাবের বিশেষ আশংকা রয়েছে। এরূপ নেতৃত্বের নির্ভরতা অনিবার্যভাবে হবে ভারত-বৈরী চীনের উপরে নির্ভরশীল। তাই বাংলাদেশের দীর্ঘায়িত গেরিলা সংগ্রাম গোটা পূর্বাঞ্চল ভারতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার গ্রহযুদ্ধের সংকট যে সৃষ্টি করতে পারে, তা নিছক অতি দূরদর্শী কল্পনা নয়।

পাক-ভারত সংঘর্ষ

 ১৫। বাংলাদেশকে এককভাবে স্বীকৃতি দিলে ভারতকে অনিবার্যভাবে পাকিস্তান বা পাক চীনের সঙ্গে সামরিক সংঘর্ষের সম্মুখীন হতে হবে, এরূপ আশংকা ও সবল যুক্তির উপরে প্রতিষ্ঠিত নয়।