পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দ্বিতীয় খণ্ড).pdf/২৬৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

236 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ দ্বিতীয় খন্ড স্মরণ রাখা দরকার যে, গত ১৭ বৎসরে দেশে শিল্পের যে অগ্রগতি সম্ভব ছিল তাহা হয় নাই। আজও ইস্পাত শিল্প ও যন্ত্র নির্মাণ শিল্প গড়িয়া উঠে নাই। দেশের মূল সম্পদ এখনও আসে কৃষি হতে। আজও দেশ অনগ্রসর কৃষি প্রধান দেশই রহিয়াছে। ইহা ছাড়া, শুধু সারা দেশের কলকারখানার সংখ্যা দ্বারা পাকিস্তানের মত দেশের উন্নয়নের পরিমাপ করা চলে না। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে- দেশের এই উভয় অংশে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলেও একই পর্যায়ে উন্নয়নকার্য চলিতেছে কিনা তাহা একটি প্রধান বিচার্য বিষয়। এই দিক দিয়া বিচার করিলে দেখ যায় যে যদিও পূর্ব পাকিস্তান সবচেয়ে বেশী বৈদেশিক মুদ্রা আহরণ করে তথাপি উহার অধিকাংশ পূর্ব পাকিস্তানের উন্নয়নের জন্য ব্যয়িত না হইয়া উহার সিংহভাগ ব্যয় করা হয় আদমজী, দাউদ, সায়গল, গান্ধারা প্রমুখ মুষ্টিমেয় বড় ধনিকের স্বার্থে। পূর্ব পাকিস্তানের উন্নয়ন পরিকল্পনা রচনা ও পরিচালনার দায়িত্ব এখানে গণনির্বাচিত সরকারের হাতে না দিয়ে উহা রাখা হইয়াছে সুদূর রাওয়ালপিন্ডিতে- বড় ধনিকগোষ্ঠীর পেটােয়া একটি চক্রের হাতে। তদুপরি,পূর্ব পাকিস্তানের শিল্প, ব্যাংক, ব্যবসা প্রভৃতির উপর অবাধ অধিকার আদমজী, দাউদ, সায়গল, গান্ধারা প্রমুখ মুষ্টিমেয় বড় ধনিকের হাতে তুলিয়া দেওয়া হয়েছে। এ সবের ফলে পূর্ব পাকিস্তানের উন্নয়ন কাজ অবেহেলিত। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ভিতর বৈষম্য বিরাজ করিতেছে। পশ্চিম পাকিস্তানের কতকগুলি অঞ্চল বিশেষতঃ সাবেক বেলুচিস্তান ও সিন্ধু সম্পর্কেও একই কথা খাটে। ধনিকদের স্বার্থরক্ষায় যে নীতি অনুসরণ করিতেছে, তাহার ফলে দেশে এক বৈষম্যমূলক ও অসম অর্থনীতি গড়িয়া উঠিয়াছে। ইহার পরিমাণ হইবে মারাত্মক। দ্বিতীয়তঃ দেশের উন্নয়নের প্রধান নিরিখ হইল জনগণের জীবন ধারণের উন্নয়ন। এদিক দিয়া বিচার করিলেও দেখা যায় যে, আদমজী, দাউদ, সায়গল, গান্ধারা প্রমুখ সামান্য কয়েকটি ধনিক পরিবার শ্রমিকদিগকে শোষণ করিয়া বৎসরে কোটি কোটি টাকা মুনাফা করিতেছে। ইহাদের মুনাফার হার হইল শতকরা ২০০-৩০০ ভাগ, যা সভ্য দুনিয়ার কোন দেশেই নাই, কোন কোন কোম্পানী- যেমন গান্ধারা ইন্ডাষ্ট্রীজ গত ৪/৫ বৎসরে কোটি কোটি টাকার মালিক হইয়াছে। অপরদিকে সমস্ত কল-কারখানা যাঁহাদের শ্রমে চালু থাকে, সেই শ্রমিকের শ্রেণী থাকে উপবাস। মুষ্টিমেয় বৃহৎ ব্যবসায়ী বাজারের কারসাজি দ্বারা জিনিসপত্রের দাম ক্রমাগত বাড়াইতেছে। এই ফটকাবাজ দ্বারা ইহারা কোটি কোটি টাকা লাভ করে। অপরদিকে নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্রের দাম আকাশচুম্বী হওয়ার ফলে জনগণের ঘরে ঘরে হাহাকার পড়িয়া গিয়াছে। ভূমি ব্যবস্থার ক্ষেত্রে গণবিরোধী আইয়ুব সরকার পূর্ব পাকিস্তানের বড় বড় জোতদারদের জমির সিলিং ১০০ বিঘা হইতে বৃদ্ধি করিয়া ৩৭৫ বিঘায় স্থির করিয়াছে। অপরদিকে, কৃষকদের ভিতর শতকরা ৭৬ জন হইল ভূমিহীন ও গরীব। পশ্চিম পাকিস্তানে বড় বড় ভূস্বামীদের জমির সিলিং ১৫০০ বিঘায় স্থির করা হইয়াছে। পক্ষান্তরে, সেখানে শতকরা প্রায় ৮০ জন ভূমিহীন ও গরীব। সারা পাকিস্তানে কৃষকদের উপর খাজনা ও ট্যাক্স বহুগুণ বৃদ্ধি করা হইয়াছে। ভূমি ব্যবস্থার ক্ষেত্রে গণবিরোধী সরকারের এইসব নীতি ও কাজের ফলে আমাদের দেশের কৃষকগণ, যাহারা জনসংখ্যার প্রায় ৮০ ভাগ, তাঁহারা অভাব, উপবাস ও অশিক্ষার অন্ধকারে ডুবিয়া আছেন। ইহাই হইল আইয়ুবী উন্নয়নের আসল চেহারা। গ্রামের ওয়ার্কাস প্রোগ্রাম হইয়াছে দুনীতির এক আখড়া। ওয়ার্কস প্রোগ্রামের টাকা আসে পি,এল ৪৮০ ধারা অনুযায়ী প্রদত্ত আমেরিকার দেওয়া গম বিক্ৰী হইতে।