পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/২৪৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
২২৪

মুখরিত হয়ে উঠল। বুঝলাম নয়নপুর আমাদের দখলে এসেছে। সংযোগের অভাবে কিছুই ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না। বাকি সৈন্যদের বললাম মৌলভীবাজরের দিকে অগ্রসর হতে। বিকেল হয়ে গেছে। পৌঁছলাম মৌলভীবাজারে। মনে হচ্ছিল মৌলভীবাজারে যেন শ্মশান হয়ে গেছে। লোকজন প্রায় নেই বললেই চলে। সার্কিট হাউসে এসে উঠলাম। আমার সৈন্যরাও আসতে লাগল। জয় বাংলা ধ্বনিতে সারা শহরটা মুখরিত হয়ে উঠল। লোকজন মনোবল না পেয়ে আমাদের কাছে আসতে লাগল।

 রশীদপুর থেকে ক্যাম্প উঠিয়ে মৌলভীবাজারে ক্যাম্প করলাম। কারণ ওখান থেকে আমার সিলেট আক্রমণ করা সুবিধা হবে। জেনারেল রবকে একথা বলতে তিনি আমার কথা মেনে নিলেন। মৌলভীবাজারের অবস্থানটি এমনি জায়গায় যেখান থেকে দুটো প্রধান সড়ক, সিলেট থেকে একটা কুলাউড়া হয়ে, অন্যটি শেরপুর শাহীদপুর হয়ে মৌলভীবাজারে আসা যায়। যদি শত্রুরা স্থলপথে কুমিল্লা অথবা ব্রাহ্মণবাড়িয়া যেতে চায় তাহলে মৌলভীবাজারে ওদের আসতে হবে। একথা ভেবে মৌলভীবাজারকে প্রাধান ঘাঁটি করে রাখলাম। খবর নিতে আরম্ভ করলাম শত্রুরা কোথায় এবং খবর পেলাম কুলাউড়ার দিকে শত্রুরা নেই। স্থলপথ সিলেট থেকে মৌলভীবাজার রাস্তাটা অনেক দীর্ঘ। তাই শত্রুরা শেরপুর-শাদীপুরের রাস্তাই বেছে নেবে। শত্রুরা এ রাস্তা বেছে নোবার আর একটা কারণ আমার সৈন্যদের সিলেটে যেতে হলে দুটো বড় বড় নদী পার হতে হবে। এই চিন্তা করে আমার কাছে যা সৈন্য ছিল তা নিয়ে শেরপুর-শাদীপুরের রাস্তায় সিলেট যাবার জন্য মনস্থ করলাম।

 মৌলভীবাজারকে শক্ত ঘাঁটি হিসাবে ব্যবহার করার জন্য জেনারেল রব এবং মানিক চৌধুরীকে বললাম যে আমার আরো অস্ত্রশস্ত্র এবং সৈন্যের প্রয়োজন। শেরপুর-শাদীপুরের রাস্তায় সিলেট যেতে হলে দুটো বড় বড় নদী আমাকে পার হতে হবে। যে সৈন্য আমার কাছে এখন আছে তা দিয়ে দুটো নদী পার হয়ে শত্রুর মোকাবিলা করে সিলেট পৌঁছানো কষ্টসাধ্য ব্যাপার। জেনারেল রব এবং মানিক চৌধুরীকে এ কথা বলতে তারা আমাকে আশ্বাস দিলেন যে কিছু দিনের মধ্যে সৈন্য- গোলাবারুদ এসে যাবে।

 পাকিস্তনীদের যুদ্ধের হাবভাব দেখে বুঝতে পারলাম ওরা বড় রকমের কোন যুদ্ধ করবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না ওরা সিলেটে একত্রিত হচ্ছে। তবে শেরপুর-শাদীপুরে দুটো নদীতে ওরা ভালভাবে বাধা দেবে সেটা বুঝতে পারলাম এবং সেজন্য তৈরি হতে লাগলাম।

 আস্তে আস্তে অস্ত্রশস্ত্র ও সৈন্য বাড়তে লাগল। জেনারেল রব সীমান্তে গিয়ে বিডিআর-এর বাঙ্গালী ছেলেদের একত্রিত করে মৌলভীবাজরে পাঠাতে লাগলেন। মানিক চৌধুরী অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করতে লাগলেন। আমার সৈন্য তখন প্রায় ৪৫০ জনের মত হয়ে গেল।

 মৌলভীবাজার ও শ্রীমঙ্গলের জনগন আমাকে অনেক সাহায্য করেছেন। গিয়াসুদ্দিন সাহেব, তোয়াবুর রহীম, আজিজ, ডক্টর আলী, আলতাফ, ইলিয়াস এবং স্কুল-কলেজের ছাত্রদের কথা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি। সৈন্যদের দেখাশুনা, খাওয়া-দাওয়ার সবরকমের ব্যবস্থা যদি মৌলভীবাজার ও সিলেটের জনগন না করতো তাহলে সিলেটকে শত্রুমুক্ত করা সম্ভব হত না।

 ইতিমধ্যে খবর পেলাম প্রায় দুই প্লাটুন পাকিস্তানী সৈন্য শেরপুরে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে এবং এক প্লাটুন-এর বেশী সৈন্য শাদীপুর রক্ষা করছে। সৈন্যদের সমাবেশ দেখে বুঝলাম এরা বড় রকমের যুদ্ধ করবে না। আরো খবর পেলাম, পাকিস্তানীদের কাছে স্বয়ংক্রিয় মেশিনগান, তিন ইঞ্চি মর্টার, দুই ইঞ্চি মর্টার ইত্যাদি আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র আছে। লোকের আসা-যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। শেরপুর-শাহীদপুরের দুটো ফেরী ওদের কছে আছে। কোন নৌকা এদিকে চলাচল করতে পারছে না। ওদের সঙ্গে একজন অফিসারও আছে জানতে পারলাম। যেভাবে হোক সিলেট আমাকে জয় করতেই হবে।

 ৪ঠা এপ্রিল রাত আটটায় শেরপুরের কাছাকাছি প্রতিরক্ষারব্যূহ তৈরী করলাম। পরদিন আক্রমণ করব স্থির করলাম।