পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৩১৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: নবম খণ্ড
২৯১

 আবার সেই দিনই (২৬শে মার্চ) দিবাগত রাত্রে বাঙ্গালী ক্যাপ্টেন নজির আহমেদ সুবেদার আতাউল হকসহ ৩০ জনের একটি প্লাটুন সেক্টর সদর দিনাজপুর হইতে আমাদের সাহায্যার্থে ঠাকুরগাঁ আসিয়া হাজির হইলেন। এই দলে পশ্চিমারা ছিল প্রায় ডজন খানেক। আমাদের হেডকোয়ার্টার সংরক্ষণ ও টাউন পেট্রল ডিউটি সমানে চলিতে লাগিল। প্রায় এক কোম্পানী লোক ইহাতে নিয়োজিত রহিল। ২৭তারিখ আবার ঠাকুরগাঁ টাউন রক্তে রঞ্জিত হইল আমাদের নির্মম গুলির আঘাতে। এই একটি নিষ্পাপ শিশু নিহত হইল। আমাদের ডিউটি চলিতে লাগিল। ইতিমধ্যে জনসাধারণের মনোবল ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে, তাহারা ততক্ষণে টাউন ছাড়িয়া পলাইতে শুরু করিয়াছে।

 আমি সেই দিনই সুবেদার হাফিজ, সুবেদার আতাউল হক, নায়েক সুবেদার মতিউর রহমান, হাবিলদার আবু তালেব ও নায়েক আব্দুল হাকিমকে নিয়া এক গোপন আলোচনা সভায় বসিয়া সিদ্ধান্ত নিলাম পরদিন ভোর ৬টায় পশ্চিমাদের উপর আমাদের তরফ হইতে আক্রমণ চালানো হইবে। কিন্তু হায়, পরিকল্পনা অনুসারে সুবেদার হাফিজ যখন পশ্চিমানিধনে উদ্যত হইলেন তখন জনৈক বাঙ্গালী হাবিলদারের অসহযোগিতার দরুন তাহা বাধাপ্রাপ্ত হইয়া সেই দিনকার মহত আক্রমণ স্থগিত রহিল। আমরা বিশেষ চিন্তিত হইলাম, কারণ, একেত শুরুতেই বাধা আসিল, দ্বিতীয়তঃ যদি আমাদের উদ্দেশ্য ফাঁস হইয়া যায় তবে আর রক্ষা থাকিবে না।

 খোদার উপর ভরসা করিয়া সেই দিন চুপ থাকিলাম। কিন্তু সহকর্মীদেরকে নির্দেশ দিলাম সকলেই যেন জরুরী নির্দেশের অপেক্ষায় সব সময় সজাগ থাকে। এই সময় স্থানীয় আওয়ামী লীগ আমাদের কর্মসূচী জানিবার জন্য বার বার আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে, কিন্তু তাহাদেরকে বলি যে সুযোগ আসিলেই তাহা করা হইবে এবং আপনারা সজাগ থাকিয়া আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখিবেন।

 ২৮শে মার্চ ভোরেও বিশেষ কারণে পরিকল্পনামাফিক আমাদের পশ্চিমাদের উপর আক্রমণ চালানো সম্ভব হইল না। মনটা একেবারে বিগড়াইয়া গেল। খোদা না করুন আমাদের পরিকল্পনা ফাঁস হইয়া গেলে এর পরিণাম কি হইবে! আবার ঐদিকে আমাদের পাঞ্জাবী মেজর ও ক্যাপ্টেনসহ পশ্চিমাদের তৎপরতা বেশ বাড়িয়া উঠিল। আমরা সরকারী কার্যের মধ্য দিয়া খুব সতর্ক থাকিলাম। সেই দিন রিজার্ভ কোম্পানী কমাণ্ডার সুবেদার হাফিজ সেইদিনকার মত টাউন ডিউটি শেষ করিয়া ভারাক্রান্ত হৃদয়ে নিজ বিছানায় শুইয়া নানা চিন্তায় মগ্ন। প্রোগ্রাম মাফিক তার পরবর্তী ডিউটি ছিল পরদিন অর্থাৎ ২৯শে মার্চ সকাল পৌনে সাতটায়, কিন্তু সেই দিন হঠাৎ করিয়া বিকাল পৌনে চারটায় তাহাকে জরুরী পেট্রলে পাঠানো হয় ঠাকুরগাঁও-দিনাজপুর হাইরোড পর্যবেক্ষণ ও পরিষ্কার করার উদ্দেশ্যে। মেজর হুসেন নিজে তাহাকে পেট্রল সম্বন্ধে বিস্তারিত বুঝাইয়া দিয়াছিলেন। সুবেদার হাফিজ প্রভুর ইশারায় বলিতে গেলে আদেশ বর্হিভূত কাজ করিয়া অনেক দূর পথ অগ্রসর হইলেন। ফলে পথিমধ্যে দিনাজপুর হইতে পলায়নপর বাঙ্গালী ইপিআর জোয়ানদের নিকট জানিতে পারেন সেই দিন দুপুরেই দিনাজপুর সেক্টর হেডকোয়র্টার কুটিবাড়ীতে বাঙ্গালী ইপিআর লোকদের সঙ্গে আর্মি ও ইপিআরের পশ্চিমাদের তুমুল সংঘর্ষ শুরু হইয়া গিয়াছে। এক নিমেষে মনে মনে তিনি নিজ কর্তব্য স্থির করিয়া সাত তাড়াতাড়ি উইং সদরে ফিরিয়া আসেন। তখন সন্ধ্যা সমাগত প্রায়। আসিয়াই তিনি মাগরেবের নামাজের জন্য আমাকে মসজিদে উপস্থিত পান এবং উপরোক্ত বিষয় অবহিত করেন। অপরদিকে কিছুক্ষণের মধ্যেই বিশ্বস্তসূত্রে জানিতে পারিলাম রাত্রি পৌনে ১১টায় উইং-এর শেষ পেট্রল লাইনে ফিরে আসার পরপরই বাঙ্গালীদের উপর হামলা শুরু করার নির্দেশ এবং আমাকে গ্রেফতার করার আদেশ সৈয়দপুর আর্মি হেডকোয়ার্টার দিয়া দিয়াছে। অতএব আমার বাসায় সুবেদার হাফিজ, ৮ উইং-এর সুবেদার আতাউল হক, নায়েক সুবেদার মতিয়ুর রহমান ও আরও জন তিনেক জোয়ন একত্রিত হইয়া মিনিট কয়েকের মধ্যেই সিদ্ধান্ত নিলাম বিপ্লব ঘটাইবার এবং সেই রাতেই। এমন সময় উইং কমাণ্ডার হইতে আদেশ আসিল সব হাতিয়ার ম্যাগাজিনে জমা দিতে হইবে। মুহূর্তে খানদের চক্রান্ত সম্বদ্ধে আমার দ্বিধা দূর হইল। আমি আরও শক্ত হইয়া বাঙ্গালী সহকর্মীদিগকে অস্ত্র জমা না দিবার নির্দেশ দিলাম। পরম পরিতোষের বিষয় কসলেই একবাক্যে আমার আদেশ মান্য করিল এবং হাতিয়ার জমা দেওয়া হইল না একটিও। বিপ্লব করিতেই হইবে, অথচ এদিকে অসুবিধা ছিল ঢের। গোটা এক প্লাটুন টাউনে গিয়াছে পেট্রলে, বাকী সব