নিয়ে আমরা দরবেশের পুলের ওপারে গিয়ে গ্রামবাসীদের ডেকে জড়ো করলাম এবং ঢাকার পরিস্থিতি ও পরিকল্পনাও জানানো হলো। এখানে গ্রামের লোকদের গাছ কাটার জন্য প্রচুর উৎসাহ দেয়া হয়। তারা নিজেরাই কুড়াল নিয়ে গাছ কাটতে শুরু করলো। এবং পরামর্শ দেয়া হলো যে, আর্মি এলে যেন তারা গ্রাম থেকে সরে যায়। অল্প সময়ের মধ্যে তারা ২০/২৫টি গাছ কেটে রাস্তার উপর ফেলে ব্যারিকেড সৃষ্টি করে। তারপর আমরা শহরের একটু বাইরে অপেক্ষা করতে থাকি পাক-সেনা শহরে ঢোকার আশঙ্কায়, কিন্তু সময় গড়িয়ে গেলো পাক-সেনাবাহিনী আসার কোন লক্ষণই দেখা গেল না। পরদিন হঠাৎ চট্টগ্রাম বেতারের জিয়াউর রহমানের ঘোষণায় আমরা সবাই খুব উজ্জীবিত হয়ে উঠি এবং ডি-সি সাহেবকে অনুরোধ করি শহরের প্রতিরক্ষা এবং যুদ্ধের জন্য তৈরি হতে। এ ব্যাপারে সামর্থ্য এবং মওজুদ অস্ত্রের পরিমাণ জানতে চেষ্ঠা করি। কিন্তু পুলিশ বাহিনী সোনাবহিনীর সাথে সম্মুখযুদ্ধে যাওয়া সম্ভব নয় বলে মত প্রকাশ করে। আমরা এই সময় জানতে পারি যশোর ক্যাণ্টনমেণ্টের জনগণ এবং পুলিশ দ্বারা অবরুদ্ধ আছে। ২৮ মার্চ ঢাকা থেকে আওয়ামী লীগ নেতা এবং ঢাকায় অবস্থানরত ফরিদপুরবাসীরা ফরিদপুর আসতে শুরু করে। তাদের মুখে ঢাকার সামরিক বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের কাহিনী শুনে আমাদের মধ্যে প্রতিরোধস্পৃহা আরো বেড়ে ওঠে। তখন আমরা কোনরকম প্রতিরোধের তৎপরতা না দেখে শহরের কতিপয় তরুণের সাথে এ ব্যাপারে আলাপ করি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪/৫ জন ছাত্র নিয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নিই যে, পাকিস্তান সেনাবহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধের পদ্ধতি হবে গেরিলা যুদ্ধ এবং অবিলম্বে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ শুরু হওয়া উচিত এবং এ প্রশিক্ষণে ষোল বছরের ঊর্ধ্বের সকল সুস্থ লোকের অংশগ্রহণে আহ্বান জানানো উচিত। এই বৈঠক চলাকালে আমাদের সাথে যোগাযোগ এবং উৎসাহিত করেন নৌ বাহিনীর একজন প্রাক্তন সদস্য জনাব হাবিবুর রহমান। তিনি নিজেকে কমাণ্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনের একজন ঘনিষ্ঠ লোক হিসেবে পরিচয় দেন। এই সিদ্ধান্ত হবার পর শহরে মাইকযোগে ঘোষণা করা হয় যে, প্রতিরোধের যুদ্ধে অংশগ্রহন করার জন্য সামরিক ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে এবং রাজেন্দ্র কলেজ প্রাঙ্গণে সকলকে উপস্থিত হওয়ার জন্য বলা হচ্ছে। সেই সাথে আরো ঘোষণা করা হয় যে, ছুটিরত পাক বাহিনীর বাঙালী সৈনিক ভাই এবং প্রাক্তন সৈনিক ভাইদেরও কলেজ প্রাঙ্গণে আসার জন্য বলা হচ্ছে। এই ঘোষণার পর প্রায় দু'শো লোক কলেজ ময়দানে হাজির হয়। এদের মধ্যে ছুটিরত এবং প্রাক্তন পাক-সেনাবাহিনীর সংখ্যাও ছিল প্রায় ৬/৭ জন। স্টেডিয়ামের একটি রুমকে এই প্রশিক্ষণের হেডকোয়ার্টারে রূপান্তরিত করা হয়। প্রথমে কলেজের ইউ-ও-সি ইউনিটের ডামি রাইফেল এবং পুলিশ লাইন থেকে রাইফেল এনে ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়। ফরিদপুর মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা কমিটি নাম দিয়ে এই প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ার চেষ্টা করা হয়।
ট্রেনিংয়ের সাথে সাথে জনগণের রাজনৈতিক চেতনা বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে সাইক্লোস্টাইল প্রচারপত্র বিলি করা হয়। এসব প্রচারপত্রের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল কি করে গেরিলা যুদ্ধ করতে হবে এবং পাকিস্তান সরকারকে অর্থনৈতিকভাবে বিপন্ন করার জন্য পাটচাষ বন্ধ করা ইত্যাদি। এই পর্যায়ে আমাদের ধারণা হয় এই যুদ্ধ হবে দীর্ঘস্থায়ী এবং সকল বাঙালী শিক্ষিত যুবকই পাক-সেনাবাহিনীর বুলেটের লক্ষ্য হবে। আমাদের ট্রেনিং চলাকালে কুষ্টিয়া এবং যশোরের প্রতিরোধ আন্দোলনের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করি এবং অস্ত্রের জন্য মেজর ওসমানের সাথে যোগাযোগ করি। তাঁর নির্দেশ অস্ত্র আনার জন্য যশোরে দুইজন সদস্যকে পাঠান হয়। কিন্তু কোন অজ্ঞাত কারণে তাদের অস্ত্র দেয়া হয়নি। ইতিমধ্যে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা হয়নি, এপ্রিলের প্রথম দিকে জয়দেবপুর থেকে পাক-সেনাবাহিনীর সদস্য হেমায়েত উদ্দিন তার তিন সদস্য সিপাহীসহ বেশকিছু গোলাবারুদ, গ্রেনেড, এস-এম-জি, চাইনিজ রাইফেল সহ পদ্মার চরে অবস্থান করছে বলে তৎকালীন দৈনিক পাকিস্তানের সাংবাদিক ভূঁইয়া ইকবাল আমাদের খবর দেন। আমরা কয়েকজন সদস্য পাঠিয়ে তাদেরকে স্টেডিয়ামে নিয়ে আসি এবং আমাদের এই প্রতিরোধ আন্দোলনে তাকে শরিক হতে অনুরোধ করি। কিন্তু তিনি একদিন পরে শহরের অন্যত্র অবস্থান করতে থাকেন। আমরা কামারখালী, গোয়ালন্দ এবং ভাংগা পর্যন্ত স্থানীয় প্রতিরোধ আন্দোলনের সাথে আমাদের প্রচেষ্টাকে জড়িত করার চেষ্টা করতে থাকি। দ্বিতীয়বার অস্ত্র সংগ্রহের