পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৪২৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: নবম খণ্ড
৪০২

 আজও রংপুর ও লালমনিরহাটে মিলিটারী লুণ্ঠন ও হত্যা চালায় ব্যাপক। গত তিনদিনে ৪৭ বাঙালী বুদ্ধিজীবিকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। রংপুরের ডি সি সৈয়দ আমিজ আহাসান ও এস পি আর বারিককে আজ তাদের বাড়ি থেকে ফৌজ ক্যাণ্টনমেণ্টে ধরে নিয়ে গিয়েছে। তাদেরও হত্যা করা হয়েছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

-আনন্দবাজার পত্রিকা, ৮ এপ্রিল, ১৯৭১

সংগ্রামের তৃতীয় সপ্তাহের সূচনায় পাকফৌজের পাল্টা অভিযান

তবু মুক্তিফৌজেরই প্রাধান্য

 সমগ্র উত্তরখণ্ড এবং পশ্চিমখণ্ডেরও বৃহদংশ করায়ত্ত, মুক্তিবাহিনী এই এই দাবিপত্রটি হাতে নিয়ে বাংলদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম তৃতীয় সপ্তাহে পদার্পণ করল। কুমিল্লায় গুরুত্বপূর্ন বিমানঘাঁটিটি দখলের জন্য বৃহস্পতিবার রক্তক্ষয়ী লড়াই চলে। সর্বশেষ সংবাদ, এই এলাকায় মুক্তিফৌজের চতুর্থ বেংগল রেজিমেণ্টরই প্রাধান্য। এই ক্যাণ্টনমেণ্টটি এখন সম্ভবত ফৌজের হাতে। ময়নামতী ছাউনি এলাকায় ঢুলুপাড়া বিমান ক্ষেত্রটি কার্যত মুক্তিফৌজের নিন্ত্রয়ণে।

 কলকাতায় জলপাইগুড়ি থেকে প্রাপ্ত একটি প্রকাশ, উত্তরখণ্ডে সৈয়দপুর মুজিব সেনার অধিকারে এসে গেছে। এই ছাউনিতে দুটি ট্যাংক অধিকৃত, ২০০ দখলদার সেনা নিহত। কিন্তু ফৌজী গোলায় আর বোমায় চারপাশের গ্রামের প্রায় পার হাজার লোকের প্রাণ গেছে।

 আর একটি খবর-রাজশাহী শহরের পতন। শুধু শহর নয়, রাজশাহী সেনা ছাউনিও শত্রুমুক্ত যশোরে ফৌজী বাহিনীর অবস্থা সঙ্গীন। মুক্তিবাহিনী লড়াই জোরদার করার তোড়জোড় করছে। এখানে পাকসেনার দল অবরুদ্ধ ছাউনি থেকে বেরিয়ে এসে মুক্তিফৌজের কাছে আত্মসমর্পণ করে বলে জানা যায়। সৈন্যরা বন্দী হয়, তাদের অস্ত্রশস্ত্র ও রসদ বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।

 এদিনের খবরের বিপরীতে চিত্রও আছে। দখলদার বাহিনী বসে নেই। স্থলে, জলে, অন্তরীক্ষে তাদের রনংদেহি মূর্তি দেখা গেছে। নতুন রণসম্ভার এবং মারণাস্ত্রে বলীয়নে পিণ্ডি ফৌজ শ্রীহট্ট, যশোর, কুষ্টিয়া এবং দিনাজপুর এলাকায় বহুমুখী অভিযান চালায়। একটি বাহিনী যশোর অঞ্চল থেকে এগিয়ে অগ্রসর হতে চেষ্ট করে চুয়াডাঙ্গা দিকে। আর একটি উত্তর থেকে নেমে আসে দিনাজপুর অভিমুখে, গোয়ালন্দঘাট থেকে তৃতীয় একটি সেনাদলকে কুষ্টিয়ার দিকে অগ্রসর হতে হতে দেখা যায়। পদ্মা দিয়ে পিণ্ডি ফৌজ গোয়ালন্দঘাটে নতুন সৈন্য আর সাজসরঞ্জাম নামাতে পেরেছে। লড়াই চলছে প্রচণ্ড, তবে হানাদার সেনাদল কোথাও বিশেষ সুবিধে করে উঠতে পারেনি। পাক বিমান বাহিনী এদিনও রাজশাহী, শ্রীহট্ট, নারায়ানগঞ্জের বিস্তীর্ণ এলাকায় বোমাবর্ষণ করে। তারা চারদিন কামানের গোলা ছড়িয়ে গোয়ালন্দ রসদ নামায়। কিন্তু বাধা পায় প্রবল। মুক্তিফৌজ যেন অগণিত যোদ্ধা দিয়ে একটি দুর্ভেদ্য প্রাচীর রচনা করে রেখেছিল।

 দিনাজপুর শহরের দশ মাইল দূরে ভীষণ সংঘর্ষ চলছে-অন্তত সন্ধ্যাবেলা পর্যন্ত সংবাদ ছিল এই। পরে আরও খবরে জানা যায়। চিরিরবন্দর পোরের কাছে বাধা পেয়ে তারা পিছু হটে যায়। চুয়াডাঙ্গা এলাকাতেও সংগ্রাম তীব্র। শোনা গেছে শুধু কামানের আওয়াজ, দেখা গেছে খালি ধোঁয়ার কুণ্ডলি। ভারত সীমান্ত নিকটবর্তী এই অঞ্চলে মেজর এম এ ওসমানের নেতৃত্ব মুক্তিফৌজ বাংলাদেশের সম্মান বাঁচাতে মরণপণ সংগ্রামে লিপ্ত। চালনার খাল দিয়ে হানাদারদের রণতরী চালানোর চেষ্টা মুক্তিফৌজ এদিন বার বার ব্যর্থ করে দেয়। পশ্চিম পাকিস্তানীরা খুলনা আর যশোর শহরে খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। দুটি শহরই হাজার হাজার মুক্তিফৌজ বস্তুত ঘিরে রেখেছে। খুলনা এলাকার শিল্পাঞ্চল দখলের জন্য প্রবল সংগ্রাম চলেছে। এই অঞ্চলে মুক্তিফৌজের অধিনায়ক শেখ মুজিবের ছোট ভাই শেখ নাসিরুদ্দীন।