পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/১০৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
৮৩

সহযোগিতায় তারা একটা গ্রুপ গঠন করেছেন। তিনি তাদের পক্ষে তাদের সাহয্যের আশ্বাস দিলেন। দিল্লী থেকে কলকাতা ফিরে আমরা খবর পেয়েছিলাম প্রফেসর নুরুল ইসলাম কলকাতায় আছেন।

 মন্ত্রিসভা শপথ গ্রহণের পরদিন (১৮ই এপ্রিল) স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে আরো একটি স্মরণীয় দিন। এই দিন সকালবেলা কলকাতা পাক মিশনের হোসেন আলীসহ মিশনের প্রায় সকল কর্মকর্তা বাংলাদেশের পক্ষে আনুগত্য প্রকাশ করেন। সার্কাস এভিনিউতে অবস্থিত পাক দূতাবাসে এত দিন ধরে যেখানে পাকিস্তানের পতাকা উড়তো, সেখানে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়ানো হল। এই ঘটনায় দেশে বিদেশে এক ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। দূতাবাসে সেদিন জনতার ঢল নামে। বিভিন্ন সংগঠন মিছিল করে সার্কাস এভিনিউতে এসে হোসেন আলীকে স্বাগত সম্ভাষণ জানায়। ফুলের মালায় মিশনের প্রাঙ্গণ ভরে যায়।

 বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী সর্বপ্রথম আমাকে প্রেরণ করেন হোসেন আলীকে অভিনন্দন জানাতে। হোসেন আলীর স্ত্রী, দুই কন্যা এবং এক ছেলের সাথে পরিচয় হল। তারা সকলেই স্বাধীনতা যুদ্ধে শরীক হলেন। হোসেন আলীর স্ত্রী খুবই সাহসী মহিলা। এ ব্যাপারে স্বামীকে তিনি প্রচণ্ড সাহস যুগিয়েছেন।

 বিদেশী বেতারের সাথে বাংলাদেশের পাক দস্যুদের অত্যাচারের করুণ কাহিনী তিনি বর্ণনা করেন। কান্নাজড়িত তার এই বক্তব্য কলকাতা বেতারে প্রচারিত হয়। এই মহিলার হৃদয়স্পর্শী বক্তব্য যারা শুনেছেন। তারাই মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে সহানুভূতি প্রকাশ করেছেন।

 ১৮ই এপ্রিলের পূর্ব রাতে বেগম হোসেন আলী ও তার একমাত্র মেয়ে মিলে স্বাধীন বাংলার পতাকা তৈরি করেন। আমি থাকতে থাকতে বহু লোক এলো হোসেন আলীকে অভিনন্দন জানাতে। বেশীক্ষণ সেখানে আমি অবস্থান করিনি। বহু গণ্যমান্য লোককেও আসতে দেখলাম।

 বাংলাদেশের বহু লোক পাক বাহিনীর অত্যাচারে কলকাতায় শরণার্থী হয়েছে। তাদের জন্যে সাহয্য প্রয়োজন। ১৯শে এপ্রিল থেকে বাংলাদেশ মিশনে কাপড়, অর্থ ইত্যাদি সাহায্য আসেত থাকে। হোসেন আলী আগেই পাক মিশনের অর্থ ব্যাংক থেকে তুলে রেখেছিলেন। এই অর্থ দিয়ে মিশন পরিচালনা করা হবে।

 পাক মিশনের একজন মাত্র কর্মচারী বাংলাদেশের পক্ষে আনুগত্য পোষণ করেননি। তিনি তার বাসায় রয়ে গেলেন। মিশনে আসেন না। এই ভদ্রলোকের সাথে কথা বলতে তার বাসায় গেলাম। তিনি আমার পূর্ব পরিচিত। ১৯৬৪সাল, তখন মোনায়েম খানের রাজত্ব। এই ভদ্রলোক সে সময় পাবনার পুলিশ সুপার ছিলেন। তার নাম আর আই চৌধুরী। সরকার বিরোধী এক মিছিল করায় পাবনায় সে সময় বহু লোককে গ্রেফতার করা হয়। আমাদের দলের নেতা মনসুর আলী তখন জেলে। আমি ও নাইমুদ্দিন পাবনা গিয়ে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের সাথে দেখা করি এবং পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে পত্রিকায় একটি রিপোর্ট প্রকাশ করি। জেলে আমাদের নেতাদের সাথে দেখা করার পর আদালতে তাদের জামিনের আবেদন করি।

 পুলিশ সুপার আর আই চৌধুরীর প্রচণ্ড দাপটের কথা তখন আমার মনে পড়ছিল। তবে ‘৬৪ সালের চেহারার সাথে আজকের চেহারার কোন মিল নেই। তাঁর স্ত্রী তখোনো বাংলাদেশের অভ্যন্তরে। কিছুদিন পর তাঁর স্ত্রী কলকাতা আসার পর আর আই চৌধুরী বাংলাদেশের পক্ষে তার আনুগত্য প্রকাশ করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় মেজর ডালিম তার মেয়ের সাথে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। মেয়ের পিতা রাজী হননি। পরে মেয়ে নিজেদের উদ্যোগে বিয়ে করে। তাজউদ্দিন ভাই তাদের মিলিয়ে দেন।

 ক্রমশঃ আমাদের লোকজন বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্থান সংকুলান হচ্ছে না। বিএসএফ বালিগঞ্জে একটি বাড়ী ভাড়া করে। আমরা সেই বাড়ীতে উঠি। তাজউদ্দিন ভাই ও আমি একটি ঘরে। অন্য একটি ঘরে সৈয়দ নজরুল ও মনসুর ভাই এবং পৃথক একটি ঘরে খন্দকার মোশতাককে। কামরুজ্জামান ভাই থাকতেন তার এক বন্ধুর বাড়ীতে।