পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/২১৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খন্ড
১৯৪

 আমি সে সময় রাজশাহীর জেলা প্রশাসক ছিলাম। জানুয়ারীর পরে আমাকে প্রাদেশিক সরকারের অর্থবিভাগের যুগ্ম-সচিব হিসেবে নিয়োগ করা হয়। আমি ঢাকায় এসে সার্কিট হাউসে উঠি এবং চারিদিকে খোঁজ খবর রাখতে থাকি। বাইশে ফেব্রুয়ারী যখন কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা ভেংগে দেয়া হয় তখন আমার আশংকা আরো ঘনীভূত হয় যে অবস্থা হয়তোবা খুব খারাপ, কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে এবং এই সবই হচ্ছে তারই পূর্বপ্রস্তুতি। যখন সংসদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করা হয় তখন বলা যায় আমরা এক প্রকার নিশ্চিত যে দুর্যোগ সামনেই রয়েছে। এই সময় যে গণআন্দোলনের জোয়ার বয়ে যাচ্ছিল তাতে প্রায় সবাই সামিল হয়। সবাই চাইছিল কোন না কোন ভূমিকা পালন করতে। আমরা যারা সরকারী চাকুরি করতাম এবং একই সাথে দেশ-সচেতন নাগরিক ছিলাম, তারা বিশেষভাবে আলোচনা করতে থাকি বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের কি ভূমিকা হওয়া উচিত!

 একটি সভায় আমরা একসাথে মিলিত হই এবং আলোচনার পর কয়েকটি সিদ্ধান্ত এবং ঐক্যমত্যে উপনীত হই। আসন্ন দুর্যোগ যে অভাবনীয় কিছু সেটা সবাই ধারণা করে এবং বুঝতে পারে এই চক্রান্তের পিছন একটা উদ্দেশ্য কাজ করছে-সেটি হচ্ছে বাঙালীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনকে শেষ করে দেয়া। যেভাবেই হোক অসহযোগিতা বা প্রতিরোধ করতেই হবে। দেশ ও জাতির সংকট এমনই তীব্র যে সরকারীবেসরকারী ছাপ প্রয়োগের কোন অবকাশ নেই। সমস্যা এবং বিপদ গোটা জাতির। আমাদের এই সভা অনুষ্ঠিত হয় জনাব সানাউল হকের বাসায়। জনাব সালাউদ্দিন, জনাব মুজিবুল হক এবং আরো কয়েকজন সেখানে উপস্থিত ছিলেন। আমরা ঘটনার গতিধারা পর্যালোচনা করতে থাকি। খুব সহজেই অনুমিত হয় যে প্রস্তুতি পর্ব চরমে উঠেছে। এম ভি সোয়াতে অস্ত্র এসে গেছে। আমার মনে হচ্ছিল যে ভয়াবহ কিছু ঘটার শুধু বাকি। যখন জয়দেবপুর, চাটগাঁ এবং আরো কয়েকটি জায়গায় সেনাবাহিনী মানুষ হত্যা করছে তখন ঘটনা কোন দিকে মোড় নিচ্ছে তা পরিস্কার হতে থাকে।

 এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমি ২৩ তারিখে আমার গ্রামের বাড়ী টাংগাইলের উদ্দেশে রওয়ানা হই। সেখানে গিয়ে বিভিন্ন স্তরের নেতাদের সাথে আলাপ হয়। ২৪ তারিখে আমার শ্যালিকা ঢাকা ছেড়ে আসে এবং আমাদের জানায় যে, ঢাকা এখন একটা ভয়ের শহরে পরিণত হয়েছে। ২৫ তারিখে আলোচনা ভেংগে যায়। ২৬ তারিখে ঢাকার ঘটনা আমরা জানতে পাই। এই ঘটনা শোনার পর বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা একত্রিত হন এবং সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেন আগামী কর্মসূচীর। আমাকেও এই সভায় যোগদান করতে আহ্বান করা হয় এবং সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। আমি উক্ত পরিষদের পরামর্শদাতা হিসেবে যোগদান করি। জনাব বদিউজ্জামান এই সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি হন। ঘোষণা করা হয় বাংলাদেশ স্বাধীন এবং এই স্বাধীনতা রক্ষার্থে আমরা সর্বাত্মকভাবে লড়বো।

 আমি আমার বক্তব্য রাখি এবং বলি, যে সব মানুষ এলাকায় আছে তাদের দু'টি ভাগে বিভক্ত করতে হবে। যথা-ট্রেনিংপ্রাপ্ত এবং ট্রেনিংবিহীন। এছাড়া আমরা পুলিশ ও আনসারদেরও যোগদান করতে অনুরোধ জানাই। এইভাবে বিভিন্ন কর্মীশিবির খোলা হয়। মূল সমস্যা অবশ্য একটাই, সেটা হচ্ছে অস্ত্র। খোঁজ নিয়ে জানা গেল যে, ডি,সি, এবং পুলিশ অফিসার উভয়ই অনুপস্থিত। তাঁদেরকে সংবাদ দেয়া হয় এবং তাঁরা এসে এই আন্দোলনে যোগদান করেন। এদিকে ট্রেসারীর দায়িত্বে যিনি ছিলেন তিনি বলেন যে তাঁর নিজের অবস্থা বাঁচানোর জন্য একটা কিছু লিখিত দেয়া উচিত। ওই এলাকার সর্বোচ্চ সরকারী কর্মচারী হিসেবে আমি তাঁকে লিখিতভাবে আদেশ দেই। চারিদিকে সাড়া পড়ে যায় এবং সবাই আন্দোলনে অংশগ্রহণের ইচ্ছা পোষণ করে। এক কথায় সবাই জড়িয়ে পড়ে কোন না কোন কাজে। এটা অত্যন্ত আনন্দজনক এবং অনুপ্রেরণাদায়ক হলেও নিয়মশৃংখলার সমস্যা সৃষ্টি হবার সম্ভাবনা দেখা দেয়। আমরা যতদূর সম্ভব সুসংগঠিতভাবে এই আন্দোলন গড়ে তুলতে চেষ্টা করি। আমি বুঝেছিলাম যে সরাসরি ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা না করলে অথবা অস্ত্রের সঠিক ব্যবহার না হলে অবস্থা অসুবিধাজনক হতে পারে। এই সময় টাংগাইলের ছাত্রনেতা কাদের সিদ্দিকী আমার সাথে দেখা করেন এবং