পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চম খণ্ড).pdf/১৯৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

| 70 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড বিয়োগব্যথায় শোকাতুর, ব্যাথাতুর, স্নানমুখ, জীবন্মত অবস্থায় ধুকছে। আমি কি করে এদের মুখে হাসি ফোটাব?... মৃত্যুর সঙ্গে, শত্রর সঙ্গে যে পাঞ্জার লড়াই চলছে- তার সংবাদ দিয়েছেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধামন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ। ঈদের দিনে মুক্তিবাহিনী নিবেদিতপ্রাণ সদস্যদের উদ্দেশ করে দেয়া এক বক্তৃতায় তিনি বলেছেন যে, আমরা শত্রকে চারদিক থেকে আঘাত হেনে চলেছি, দেশবাসী যেন তৈরি থাকে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যে শোষণহীন সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা কায়েম করার কথা বলেছিলেন, সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য এই মুক্তি আন্দোলন শুরু হয়েছে। শত্রকে নির্মুল করে এমন এক সুখী বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে যেখানে একজন আর একজনকে শোষণ করতে পারবে না। সবাই সমান সুযোগ-সুবিধে পাবে। এর পর পরই মুক্তিবাহিনী প্রচণ্ড বিক্রমে শত্রসেনার উপর আঘাত হেনেছে এবং খুলনা, যশোর, রংপুর, সিলেট ও চট্টগ্রাম খান সেনারা প্রচণ্ড মার খেয়ে ক্রমাগত পিছু হটে চলেছে। মুক্তিবাহিনী এখন বিজয়ের পথে। সে কথা ঘোষণা করে প্রধানমন্ত্রী গত ২৩শে নভেম্বর জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া এক বেতার ভাষণে দেশের প্রতিটি বিজয়ের পথে এগিয়ে চলেছে, শক্র দাঁতভাঙ্গা জবাব পাচ্ছে। সে এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি। তার মনোবল ভেঙে গেছে। সে বুঝতে পারছে অন্যায় টিকতে পারে না। অহঙ্কারের পতন অবশ্যম্ভাবী, অত্যাচারীর ধ্বংস অনিবার্য, পশুশক্তি মানবতার কাছে কিছুই নয়। বাংলার মানুষ আজ ইতিহাসের শুভ্রতম পৃষ্ঠাগুলো অধিকার করেছে, আর ইয়াহিয়াচক্র ইতিহাসের কৃষ্ণতম পৃষ্ঠাগুলোর মধ্যে মুখ থুবড়ে পড়ছে। এরই নাম ইতিহাস, এরই নাম মহাকাল। এরই নাম সত্যের জয়, ন্যায়ের জয়। ২ ডিসেম্বর, ১৯৭১ ... ১৯৪৭ সালে যখন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হয় তখনও আমরা জানতাম পশ্চিম পাকিস্তানের জীবনধারন পদ্ধতি, ধ্যান-ধারণা, আচার-সংস্কার প্রভৃতির সঙ্গে বহুক্ষেত্রেই আমাদের মিল নেই, তাদের সঙ্গে আমাদের গভীর পরিচয় নেই, বহুদূরে অবস্থিত সেই দেশের মানুষের সঙ্গে গভীরভাবে সব সময় পরিচায়েরও সুযোগ নেই। তবুও আমরা মিলেমিশে থাকতে চেয়েছিলাম। বহু জাতি, বহু ভাষা, বহু ধর্ম ও বহু সংস্কৃতি নিয়েও একসঙ্গে বাস করা যায়। রাশিয়া, ভারত, চীন তার প্রমাণ। আমরা আশা করেছিলাম, ইতিহাসের দৃষ্টান্ত যেমন আমরা অনুসরণ করছি তেমনি পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারাও অনুসরণ করবেন। দেয়া-নেয়া, মিলনের মধ্যদিয়ে একটি বৃহৎ মৈত্রী প্রতিষ্ঠিত হবে, সে জন্যই আমরা সব সময়ই স্বার্থ ত্যাগ করতে প্রস্তুত ছিলাম, স্বার্থ ত্যাগ করেছিও। সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও জাতীয় পরিষদে সমান সমান প্রতিনিধিত্ব আমরা মেনে নিয়েছিলাম। সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা হওয়া সত্ত্বেও এ কথা আমরা বলিনি যে একমাত্র বাংলাই রাষ্ট্রভাষা হবে। বাংলা ভাষার মর্যাদা আমরা চেয়েছিলাম, মাতৃভাষা বাংলার মাধ্যমে বিদ্যা শিক্ষা আমরা চেয়েছিলাম, কিন্তু এ কথা আমরা বলিনি যে, উর্দু সম্পূর্ণ বাদ দিতে হবে- যে উর্দুকে আমরা জানবো না, উর্দু সাহিত্য সম্পর্কে আমাদের কোন উৎসাহ নেই। বরং উর্দু ছোটগল্প, কবিতা সম্পর্কে আমাদের উৎসাহ-ই ছিল। সমসাময়িক উর্দু সাহিত্যিকদের মধ্যে ফয়েজ আহমদ ফয়েজসহ অনেকেই আমাদের পরিচিত ছিলেন। শুধু উর্দু কেন, পশ্চিম পাকিস্তানের সবকটি ভাষা সম্পর্কেই আমাদের গভীর আগ্রহ ছিল। পশতু বা সিন্ধী সাহিত্য জানবার চেষ্টা করেছি আমরা। করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিক্রিয়াশীলরা যখন পাকিস্তানী ভাষা ও সাহিত্য কেন পৃথিবীতে সমস্ত ভাষা ও সাহিত্য জানবার দরজা আমরা সব সময়ই খোলা রেখেছি। বাঙালী কি ইতোপূর্বে সংস্কৃত, ফারসী, আরবী, উর্দু, ইংরেজি শেখেনি? সেইসব ভাষা ও সাহিত্যে তাদের অধিকার অর্জন করেনি?