পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চম খণ্ড).pdf/২৭৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

255 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড পরিষদের সভা বসার আগে শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর দলকে ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্র ও ক্ষমতার বিলিবন্টন সম্পর্কে তাঁর সঙ্গে একটা সমঝোতায় উপনীত হতে হবে। তা না করা পর্যন্ত জাতীয় পরিষদের বৈঠক ডাকা হবে না। এই ধরনের একটি অযৌক্তিক দাবি ও অন্যায় আবদার গণতন্ত্রের ইতিহাসে বিরল হলেও এটাই ছিল খান যে এই সিদ্ধান্তের অন্যতম ছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া গেল যখন ভুট্টোর হুমকির সঙ্গে সঙ্গে তিনি জাতীয় পরিষদের ৩রা মার্চে আহুত সভা কোনো কারণ না দেখিয়েই অনির্দিষ্টকালের জন্যে মুতলবী ঘোষণা করে দিলেন- যদিও জাতীয় পরিণষদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য তখন পরিষদের অধিবেশনে যোগ দেবার জন্য ঢাকা এসে জমায়েত হয়েছিলেন। এর মধ্যে কাইউম খান ও ভুট্টোর দল ছাড়া অন্য সব দলের সদস্যরা ছিলেন। ইয়াহিয়া খানের এই হঠকারী ঘোষণা স্বাধিকারকামী পূর্ব বাংলার জনগণের মনে অসন্তোষের আগুন জুলিয়ে দিল। শাসকচক্রের চক্রান্তের কথা বুঝতে তাদের বাকি রইল না। আওয়ামী লাগের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান জনগণকে শান্তিপূর্ণ অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে প্রতিবাদ জানাবার আহবান জানালেন। জনগণ অহিংস অসহযোগ আন্দোলন শুরু করল। ইয়াহিয়া খানের সেনাবাহিনী এই অহিংস জনতার ওপর বিনা প্ররোচনায় গুলিবর্ষণ করল। সহসা ঢাকা শহরে কারফিউ জারি করে একরাতে তাঁর বর্বর সৈন্যেরা প্রায় দু-হাজার দেশপ্রেমিককে খুন করলো। কিন্তু এই প্ররোচনার মুখেও শেখ মুজিবর রহমান জনগণকে শান্ত থাকার আহবান জানালেন। জনগণ শান্ত রইল। তখন শাসকচক্রের ভাড়াটে দালালরা পূর্ব বাংলায় বাঙালী ও অবাঙালীদের মধ্যে একটা দাঙ্গা বাধাবার আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল। এ সময়ে শেখ মুজিবুর রহমান দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করলেন- পূর্ব বাংলার বসবাসকারী প্রতিটি মানুষ শাসকচক্র দাঙ্গা বাধাতে টিক্কা খানকে পূর্ব বাংলার সামরিক প্রশাসনের প্রধান ও গভর্নর হিসাবে নিয়োগ করে ঢাকায় পাঠান হলো। জেনারেল টিক্কা খান হচ্ছেন সেই জেনারেল- যিনি বেলুচিস্তানের নিরীহ জনগণ যখন ঈদের নামাজে অংশ নেওয়ার জন্য কাতারবন্দী হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, তখন তাঁদের ওপরে বিমান থেকে গোলাবর্ষণ করে ও মেশিনগান চালিয়ে কয়েকশ বালুচকে হত্যা করেন। সেই টিক্কা খানকে পূর্ব বাংলায় পাঠানো তাই অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। টিক্কা খান এলেন এবং তার কিছুদিন পরে ইয়াহিয়া খানও দলবল নিয়ে এলেন ঢাকায়। ১৬ই মার্চ তিনি শেখ মুজিবের সঙ্গে আলোচনায় বসলেন। মুখে আলোচনার বাণী। এবং আলোচনার মাধ্যমে সকল সমস্যার সমাধানের ইঙ্গিত আর অন্যদিকে লোকচক্ষুর অন্তরালে এক বিরাট সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি নিতে থাকলেন ইয়াহিয়া খান আর সামরিক ‘জুন্টা’র প্রধানরা। জল এবং বিমান পথ হাজার হাজার সৈন্য আমদানি করলেন তাঁরা পূর্ব বাংলার মাটিতে। সামরিক নিবাসগুলোকে আরও সুদৃঢ় করলেন। ঢাকা সৈন্যশিবির ও বিমানপোতের চারপাশে অসংখ্য বিমানধ্বংসী কামান বসান হলো। মেশিনগান বসান হলো বিমানপোতের আশেপাশের বাড়ির ছাদে। একদিকে আলোচনার প্রহসন চলল আর অন্যদিকে চলল দ্রুত সামরিক প্রস্তুতি। ২৫ শে মার্চ, ১৯৭১ এল সেইদিন, যে-দিনটির জন্যে পাকিস্তানের শাসকচক্র ১৯৬৯ সালের ২৫শে মার্চ থেকে অপেক্ষা করছিল রাতের অন্ধকারকে আশ্রয় করে মিথ্যাবাদী তস্কর ইয়াহিয়া খান চুপিচুপি ঢাকা থেকে পালিয়ে গেলেন এবং যাবার আগে তার বর্বর সেনাবাহিনীকে লেলিয়ে দিয়ে গেলেন বাংলার নিরীহ নিরপরাধ নিরস্ত্র মানুষ নিধনযজ্ঞে।