পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চম খণ্ড).pdf/২৮৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

263 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড দসু্যরা ধ্বংস করে দিয়েছে। আর জনাব মশিউর রহমান সাহেবের বাড়ি তো ছিলো এই দস্যদের প্রধান লক্ষ্যস্থল। সুতরাং সে বাড়ির যে কিছুই অক্ষত থাকবে না তা বলাই বাহুল্য। রাত তখন সাড়ে আটটার মতো হবে। কোথায় রাত কাটাবো ঠিক করে উঠতে পারছি না। একজনকে রাত কাটানোর অনুরোধ জানালে দেখিয়ে দিলেন স্থানীয় ইউনিয়ন কাউন্সিল সদস্যের বাড়ি। তবে একথাও শুনলাম ঐ সদস্য আগে জামাতে ইসলামীর লোক ছিলেন। সোজা গেলাম তার বাড়িতে। ডেকে বললাম, আমি আপনার এখানে রাত কাটাতে চাই, আমাকে থাকতে দিতে হবে। আর যদি আমাকে মিলিটারীর বা রাজাকারের হাতে তুলে দিতে চান, তাও করতে পারেন। তবে তার আগে খেতে দিতে হবে। বুঝতেই পারছেন বড়ো বেশি ক্ষুধার্তা ভদ্রলোক ছোট ভাইকে ডেকে আমার আপ্যায়নের ব্যবস্থা করলেন। বললেন, আপনি ঠিকই ধরেছেন, আমি আগে জামাতপন্থী ছিলাম। কিন্তু গতকাল থেকে আমি বাঙালী এবং এখন এটাই আমার একমাত্র পরিচয়। জানেন, গতকাল মিলিটারী আমাদের চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়ি এসে তাকে ২০টি যুবক ও কয়েকটা মেয়ে সংগ্রহ করে দিতে বলে। তিনি দুইদিনের সময় চেয়েছিলেন মাত্র। তারপর সৈন্যরা তার বাড়িতে ঢুকে চেয়ারম্যান সাহেবের পুত্রবধু ও যুবতী মেয়েকে ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যায়। তারপর তাদের ভাগ্যে কি ঘটেছে বুঝতেই পারছেন। বলতে বলতে মুহুর্তে ভদ্রলোকের মুখ-চোখের লক্ষণ পরিবর্তিত হয়ে গেলো। দেখলাম, তার সারা মুখে ঘৃণা ও গ্লানির চিহ্ন পরিস্ফুট। বাঙালী কি আর ভাইয়ের অপমান সইতে পারে? চার ৩ অক্টোবর, ১৯৭১ মেম্বার সাহেবের সাথে কথা বলতে বলতে অনেক রাত হয়ে গেল। তথাকথিত ইসলাম-দরদীদের বর্বর মানবতাবিরোধী কাজই যে জামাতপন্থী এ মানুষটিকে সত্যিকারের বাঙালীতে পরিণত করেছে তার কথাবার্তায় তা পরিস্ফুট হয়ে উঠল। স্থানীয় এলাকা সম্পর্কে অভিজ্ঞ মানুষটির কথাবার্তা থেকে আরো বুঝতে পারলাম যে, পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের প্রতিটি গুলি, প্রতিটি অত্যাচার বাঙালীর ঐক্যকে দিন দিন সুদৃঢ় করে তুলেছে। গালগল্প শেষ করে যখন শুয়ে পড়লাম তখন রাত প্রায় ১টা। চোখে তন্দ্রার ভাব আসলেও পুরোপুরি ঘুম বলতে যা বুঝায় তা তখনও আসেনি। এমনি সময়ে গগনবিদারী একটা প্রচণ্ড বিস্ফোরণে চমকে উঠলাম। এটা যে মুক্তিবাহিনী গেরিলাদের কাজ তা বুঝতে বাকী থাকল না। তবে কোথায় তারা এ বিস্ফোরণ দ্বারা কি নষ্ট করেছে তা তখনও জানতে পারলাম না। এরই কয়েক মিনিট পরে রেললাইনের দিকে আরেকটি প্রচণ্ড শব্দ হল। পরের দিন ভোরে জানতে পারলাম গেরিলারা সিংহঝুলির কাছে জোড়াপুলটি উড়িয়ে দিয়েছে। যশোর থেকে চৌগাছায় সৈন্য আনা-নেওয়ার জন্য এ পুলটির গুরুত্ব ছিল অনেক। আর দ্বিতীয় বিস্ফোরণ সম্পর্কে জানা গেল যে তা দিয়ে গেরিলারা একটি মালগাড়িসহ রেললাইন উড়িয়ে দিয়েছে। মালগাড়ির পাহারাদার কয়েকজন রাজাকার প্রাণ হারিয়েছে। সকাল তখন প্রায় ৮টা। আমি মেম্বার সাহেবের বাড়ি ছেড়ে নিজের পথে বের হয়ে পড়বো ঠিক এ সময়ে ঐখান থেকে মাইল চারেক দূরে শুরু হল মর্টার ও মেশিনগানের গোলা বর্ষণ। গোলা বর্ষণ চলছে তো চলছেই। থামার কোন লক্ষণ দেখা গেল না। তাই ব্যাপারটা না জানা পর্যন্ত মেম্বার সাহেব আমাকে ঘরের বাইরে পা দিতে নিষেধ করলেন। ইত্যবসরে একটা সাহসী তরুণকে পাঠান হল ব্যাপারটা জেনে আসতে। ঘন্টা দু’এক পরে তরুণ এসে যা জানাল তা হচ্ছেঃ প্রত্যুষের দিকে কে বা কারা যশোর-ঝিনাইদহ রাস্তার এক জায়গায় স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়িয়ে গেছে। স্থানীয় রাজাকাররা ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে খবর দিলে তারা পতাকা থেকে মাইল তিনেক দূরে এসে অবস্থান নেয় এবং সেখান থেকে অবিরাম গোলাবর্ষণ শুরু করে। পতাকা যেখানে উড়ান