পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (প্রথম খণ্ড).pdf/১৩৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খণ্ড
১১৩

 স্বাধীন পূর্ব বাংলার স্বাধীন নাগরিকরূপে আজ আমাদের প্রয়োজন হয়েছে সর্বশাখায় সুসমৃদ্ধ এক সাহিত্য। এই সাহিত্যে আমরা আজাদ পাক-নাগরিক গঠনের উপযুক্ত প্রয়োজনীয় বিষয়ের অনুশীলন চাই। এই সাহিত্য হবে আমাদের মাতৃভাষা বাংলায়। পৃথিবীর কোন জাতি জাতীয় সাহিত্য ছেড়ে বিদেশী ভাষায় সাহিত্য রচনা করে যশস্বী হতে পারেনি। ইসলামের ইতিহাসের একেবারে গোড়ার দিকেই পারস্য আরব কর্তৃক বিজিত হয়েছিল, পারস্য আরবের ধর্ম্ম নিয়েছিল, আরবী সাহিত্যের চর্চা করেছিল। কিন্তু তাঁর নিজের সাহিত্য ছাড়েনি। তাই রুদাগী ফিরদৌসী, নিযামী, সাদী, হাফিয, উফি, খাকানী, বুআলী সীনা, গাযালী, খায়্যাম প্রমুখ কবি, ভাবুক সুফী ও দার্শনিক লেখকগণের রচনায় পারস্য সাহিত্য গৌরব-সমুজ্জ্বল। বাংলা সাহিত্যের চর্চা আমাদের মধ্যে আজ নূতন নয়। বাংলাদেশ যখন দিল্লীর অধীনতা-নিগড় থেকে মুক্ত হয়ে গৌড়ে এক স্বাধীন সুলতানত প্রতিষ্ঠা করে, তখন থেকেই বাংলা সাহিত্য সৃষ্টির দিকে রাজার মনোযোগ পড়ে। ইউসুফ শাহ হোসেন শাহ, নসরত শাহ, ফিরোয শাহ, নিযাম শাহশূর, ছুটী খাঁ, পরাগল খাঁ প্রভৃতি রাজা ও রাজপুরুষগণ বাংলা সাহিত্যের উৎসাহদাতা ছিলেন। হিন্দু কবিরা মুক্তকষ্ঠে তাদের যশ কীর্তন করে গেছেন। কৃত্তিবাসের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এক গৌড়েশ্বর। তাঁর প্রশংসায় কবি বলেছেন-

“পঞ্চ গৌড় চাপিয়া গৌড়েশ্বর রাজা।
গৌড়েশ্বর পূজা কৈলে গুণের হয় পূজা।”

 এই গৌড়েশ্বর খুব সম্ভবতঃ রাজা গণেশ নন; কিন্তু তাঁর পুত্র উত্তরাধিকারী জালালুদ্দীন মুহম্মদ শাহ। রাজা গণেশের রাজত্বকাল অল্প এবং অশান্তিপূর্ণ ছিল। আমরা তাঁকে সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকরূপে কোথাও দেখি না। অন্যপক্ষ জালালুদ্দীন মুহম্মদ শাহ দীর্ঘকাল শান্তিতে রাজত্ব করেন (১৪১৯-১৪৩১ খ্রীঃ)। তিনি ভরত মল্লিককে নানা উপহাসহ বৃহস্পতি ও রায়মুকুট এই দুই উপাধি দিয়েছিলন। কৃত্তিবাস স্বধর্ম্মত্যাগী বলে বোধ হয় এই গৌড়েশ্বরের নাম উল্লেখ করেননি।

কবীন্দ্র পরমেশ্বর সুলতান আলীউদ্দীন হোসেন শাহের প্রশংসায় বলেছেন-

“কলিযুগ অবতার গুণের আধার
পৃথিবী ভরিয়া যাঁর যশের বিস্তার।
সুলতান আলাউদ্দিন প্রভু গৌড়েশ্বর
এ তিন ভুবনে যাঁর যশের প্রসার।”

শ্রীকর নন্দী নসরত শাহের প্রশংসায় বলেছেন-

“নসরত শাহ নামে তথি অধিরাজ
রাম সম প্রজা পালে করে রাজ-কাজ।”

কবি শেখর এই নসরত শাহের প্রশংসায় বলেছেন-

“কবি শেখর ভণ অপরূপ রূপ দেখি
রায় নসরত শাহ ভজলি কমলমুখী”।

(মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে মুসলমানের অবদান হিন্দু অপেক্ষা কম নয়।)

 পল্লীগীতিকায় মুসলমানের দান অতি মহৎ কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থসাহায্যে জ্যেষ্ঠ সহোদরকল্প। পরলোকগত দীনেশচন্দ্র সেনের আগ্রহে ও উৎসাহে যে গাথাগুলি সংগৃহীত হয়েছে, তা ছাড়া আরও বহু পল্লীকবিতা পূর্ব্ববঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং পূর্ব্ববঙ্গের সরকার কি এদিকে মনোযোগ দিবেন? এইে পল্লীকাব্য সম্বন্ধে দীনেশবাবু বলেছেন, “এই বিরাট সাহিত্যের সূচনা আমি যেদিন পাইয়াছিলাম, সেদিন আমার জীবনের এক স্মরণীয় দিন। আমি সেদিন দেশ-মাতৃকার মোহিনীমূর্ত্তি দেখিয়া মুগ্ধ হইয়াছিলাম, আমাদের বাংলা ভাষার শক্তি ও প্রসার দেখিয়া বিস্মিত হইয়াছিলাম এবং হিন্দু ও মুসলমানের যে যুগলরূপ দেখিয়াছিলাম-