পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (ষষ্ঠ খণ্ড).pdf/৪৮৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

451 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ ষষ্ঠ খণ্ড যুক্তফ্রন্টের ভাঙ্গন সৃষ্টির কাজে এই সব দলগুলোকে সক্রিয় করে তোলে এবং পরবর্তীকালে তথাকথিত বাঙালী বগুড়ার মোহাম্মদ আলীকে দিয়ে নয়া মন্ত্রিসভা গঠন করে। কিন্তু ধামাচাপা দেয়া মন্ত্রিসভার আসল চরিত্রও জনগণের কাছে ফাঁস হয়ে যায়। কোনমতেই যখন পূর্ব বাংলার জাতীয়তাবাদী জনগণকে দমিয়ে রাখা যাচ্ছিল না তখন তারা শেষ অস্ত্র নিয়ে রাজনৈতিক মঞ্চে অবতীর্ণ হয়। দেশে সামরিক শাসন জারি করে মুসলিম লীগকেই আবার চাঙ্গা করে তোলে। ১৯৬২ সালে নয়া শিক্ষানীতি পূর্ব বাংলার উপর চাপিয়ে দিতে গেলে বাংলার ছাত্র সমাজ রুখে দাড়ায়। শিক্ষানীতির পিছনে একটি মাত্র লক্ষ্য ছিল, পূর্ব বাংলার জনগণকে শিক্ষার আলো থেকে সম্পূর্ণ দূরে সরিয়ে রাখা। এই শিক্ষানীতি চালু করার জন্যে তারা তাদের দুটো লেজুড় ছাত্র সংগঠন এস, এস, এফ এবং ইসলামী ছাত্র সংঘকে কাজে লাগায়। এখানে একটা কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই পূর্ব বাংলার সবচেয়ে সচেতন অংশ ছাত্রসমাজের উপর পর পর আক্রমণের কারণ হলো এই যে, প্রতিক্রিয়াশীল চক্র খুব ভালভাবেই জানতো যে বাংলার ছাত্র সমাজই পাকিস্তানের রাজনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সুতরাং এদের আমল দিলে অচিরেই পাকিস্তান রাষ্ট্রে অবলুপ্তি ঘটবে। তাই ছাত্র তরুণের প্রাণ বিসর্জন না হওয়া পর্যন্ত কোন দাবীই তারা মেনে নেয়নি। ১৯৬৪ সালে চণ্ড মোনায়েম খাঁকে দিয়ে সমাবর্তন উৎসব অনুষ্ঠানের চেষ্টা করলে সাধারণ ছাত্রসমাজ আবার রুখে দাঁড়ায়। তখন মুসলিম লীগ ও জামাত ইসলাম তাদের ছাত্র সংগঠনকে দিয়ে এই উৎসব সফল করে তোলার জন্যে পাল্টা উদ্যোগ নেয় কিন্তু স্থিরপ্রতিজ্ঞা ছাত্রসমাজ এই উদ্যোগে সাড়া না দিয়ে সমাবর্তন বর্জন করে। তখন শাসকচক্রের দালাল ছাত্র সংগঠন ও ভাড়া করা গুণ্ডা নিয়ে সাধারণ ছাত্রদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এই ঘটনার পর পরই মুসলিম লীগ, জামাতে ইসলাম প্রভৃতি দলগুলো জনগণের সংগ্রামী ধারাকে অন্যখাতে প্রবাহিত করার জন্যে এই পূর্ব বাঙলার বুকে হিন্দু মুসলমান দাঙ্গা বাধায়। নিরীহ হিন্দুদের বাঁচাতে গিয়ে এ সময় অনেক রাজনৈতিক কর্মীও প্রাণ হারান। দাঙ্গার পরপরই তারা কাশ্মীর সমস্যার ধুয়া তুলে ভারতবিদ্বেষী মনোভাব জনগণের মধ্যে ছড়াতে শুরু করে। এভাবে পুরো দশটি বছর একের পর এক আক্রমণ চালিয়ে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংগঠনগুলোকে প্রতিরক্ষামূলক আন্দোলনে ব্যাপৃত রাখে। কিন্তু প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনই পূর্ব বাংলার জনগণকে রাজনৈতিকভাবে অনেক বেশী সচেতন করে তোলে। তাই যখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার দোহাই দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানকে বন্দী করা হয় তখন বাঙলার মানুষ আর চুপ করে বসে থাকে না। ১৯৬৯ সালে পূর্ববাংলার ছাত্র সমাজ ১১ দফার ভিত্তিতে ব্যাপক গণআন্দোলনের আহবান জানালে পূর্ব ংলার জনগণ স্বতঃস্ফুর্তভাবে সেই আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়েন। সিময় পি ডি পি, জামাতে ইসলাম, নেজামে ইসলাম ও মুসলিম লীগ যৌথভাবে ১১ দফার পাল্টা হিসাবে আট দফা দাবী জনগণের সামনে পেশ করে। আন্দোলনের নামে পূর্ব বাংলার জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্যেই এই আট দফা উত্থাপন। কিন্তু সকল আন্দোলনে এদের ভূমিকা সম্পর্কে জনগণ সচেতন হওয়ায় আট দফা জনগণের মধ্যে সাড়া জাগাতে সম্পূর্ণরুপে ব্যর্থ হয়। এইভাবে প্রতিটি আন্দেলনেই তাদের নির্লজ্জ ভূমিকা জনগণকে অনেক বেশী সচেতন করে দিয়েছে। তাই যখণ নুরুল আমিনের মুখে উত্তরবঙ্গের স্বায়ত্তশাসনের দাবী উঠতে দেখা যায়, জনগণের পক্ষ থেকে তখন তেমন কোনরুপ সাড়া পরিলক্ষিত হয় না। পূর্ব বাংলার বিগত আন্দোলনে পি ডি পি, জামাত, নেজাম ইসলাম, মুসলিম লীগ প্রভৃতি দলগুলো যেমন একদিকে জনগণ থেকে আস্তে আস্তে বিচ্ছিন্ন হয়েছে অন্য দিকে তেমনি তারা পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ও অন্যান্য প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েছে।