পাতা:বাংলা শব্দতত্ত্ব - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৩৩৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

জাতীয় সাহিত্য

আমরা ‘বাংলা জাতীয় সাহিত্য’ প্রবন্ধের নামকরণে ইংরাজি ‘ন্যাশনাল’ শব্দের স্থলে ‘জাতীয়’ শব্দ ব্যবহার করিয়াছি বলিয়া ‘সাহিত্য’-সম্পাদক মহাশয় আমাদের প্রতি কিঞ্চিৎ শ্লেষকটাক্ষপাত করিয়াছেন।

 প্রথমত, অনুবাদটি আমাদের কৃত নহে; এই শব্দ বহুকাল হইতে বাংলা সাহিত্যে ন্যাশনাল-শব্দের প্রতিশব্দরূপে ব্যবহৃত হইয়া আসিতেছে। দ্বিতীয়ত, ভাষার পরিণতি সহকারে স্বাভাবিক নিয়মে অনেকগুলি শব্দের অর্থ বিস্তৃতি লাভ কয়ে। সাহিত্য শব্দটি তাহার উদাহরণস্থল। সাহিত্য-সম্পাদক মহাশয়ও ‘সাহিত্য’ শব্দটিকে ইংরাজি ‘লিটারেচর’ অর্থে প্রয়োগ করিয়া থাকেন। সম্পাদক মহাশয় সংস্কৃতজ্ঞ, ইহা তাঁহার অবিদিত নাই যে, ‘লিটারেচর’ শব্দের অর্থ যতদূর ব্যাপক, সাহিত্য শব্দের অর্থ ততদুর পৌঁছে না। শব্দকল্পদ্রুম অভিধানে ‘সাহিত্য’ শব্দের অর্থ এইরূপ নির্দিষ্ট হইয়াছে ‘মনুষ্যকৃতশ্লোকময়গ্রন্থবিশেষঃ। স তু ভট্টিরঘুকুমারসম্ভবমাঘভারবিমেঘদূতবিদগ্ধমুখমণ্ডনশান্তিশতকপ্রভৃতয়ঃ।’ এমন-কি, রামায়ণ মহাভারতও সাহিত্যের মধ্যে গণ্য হয় নাই, তাহা ইতিহাসরূপে খ্যাত ছিল। এইজন্য মহারাষ্ট্রীয় ভাষায় ‘সাহিত্য’ শব্দের পরিবর্তে ‘বাঙ্ময়’ শব্দ ব্যবহৃত হইয়া থাকে। বন্ধুবংশের তৃতীয় সর্গে ২৭শ শ্লোকে আছে—

লিপের্যথাবদ্‌গ্রহণেন বাঙ্ময়ং
নদীমুখেনেব সমুদ্রমাবিশৎ।

অর্থাৎ রঘু লিপিরূপ নদীপথ দিয়া বাঙ্ময়রূপ সমুদ্রে প্রবেশ করিলেন।

 ‘জাতি’ শব্দ এবং ‘নেশন্‌’ শব্দ উভয়েরই মূল ধাতুগত অর্থ এক। জন্মগত ঐক্য নির্দেশ করিবার জন্য উভয় শব্দের উৎপত্তি। আমরা ব্রাহ্মণ প্রভৃতি বর্ণকে জন্মগত ঐক্যবশত জাতি বলি, আবার বাঙালি প্রভৃতি প্রজাবর্গকেও সেই কারণেই জাতি বলিয়া থাকি। জাতি শব্দের শেষোক্ত প্রয়োগের স্থলে ইংরাজিতে ‘নেশন্’ শব্দ ব্যবহৃত হয়। যথা, বাঙালি জাতি = বেঙ্গলি নেশন্। এরূপ হলে ‘ন্যাশনাল’ শব্দের প্রতিশব্দরূপে ‘জাতীয়’ শব্দ ব্যবহার করাতে বিশেষ দোষের কারণ দেখা যায় না। আমরাও তাহাই করিয়াছি। কিন্তু সম্পাদক মহাশয় অকস্মাৎ অকারণে অনুমান করিয়া লইয়াছেন যে আমরা ‘জাতীয় সাহিত্য’ শব্দে ‘ভর্ন্যাকুলর লিট্‌রেচর্‌’ শব্দের অপূর্ব তর্জমা করিয়াছি। বিনীতভাবে জানাইতেছি