পাতা:বাংলা শব্দতত্ত্ব - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৯৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
বাংলা শব্দদ্বৈত
৭৭

গলায় গলায় (আহার), কানে কানে (কথা)—ইহাও পূর্বশ্রেণীর; অর্থাৎ অত্যন্তই গলা পর্যন্ত পূর্ণ, নিতাই কানের নিকটে গিয়া কথা। হাতে হাতে (ফল, বা ধরা পড়া), বোধ করি স্বতন্ত্রভাতীয়। বোধ করি তাহার অর্থ এই যে, যেমনি হাত দিয়া কাজ করা অমনি সেই হাতেই ফল প্রাপ্ত হওয়া, যেহাতে চুরি করা সেই হাতেই ধৃত হওয়া।

 নিজে নিজে, আপনি আপনি, তখনই তখনই— পূর্বানুরুপ। অর্থাৎ বিশেষ রূপে নিজেই, আপনিই আর কেহই নহে, বিলম্বমাত্র না করিয়া তৎক্ষণাৎ। সকাল সকাল শব্দও বোধ করি এই-জাতীয়, অর্থাৎ নিশ্চয়রুপে দ্রুতরূপে সকাল।

 জল জল, চুর চুল, ঘুর ঘুর, টল টল, নড়, নড়, এগুলি অলন চূর্ণন ঘূর্ণন টলন নর্তন শব্দজাত; এগুলিতেও প্রভাব ব্যক্ত হইতেছে।

 বাংলা অনেকগুলি শব্দদ্বৈতে দ্বিধা ঈষদুনতা, মৃদুতা, অসম্পূর্ণতার ভাব ব্যক্ত করে; যথা, যাব যাব, উঠি উঠি; মেঘ মেঘ, জর জর, শত শত, মর মর, পড়ো পড়ো, ভরা ভরা, ফাঁকা ফাঁকা, ভিজে ভিজে, ভাসা ভাসা, কাঁদো কাঁদো, হাসি হাসি।

 মানে মানে, ভাগ্যে ভাগ্যে শব্দের মধ্যেও এই ঈষদুনতার ভাব আছে। মানে মানে পলায়ন, অর্থে— মান প্রায় যায় যায় করিয়া পলায়ন। ভাগ্যে ভাগ্যে রক্ষা পাওয়া অর্থাৎ যেটুকু ভাগ্যসূত্রে রক্ষা পাওয়া গেছে তাহা অতি ক্ষীণ।

 ঘোড় ঘোড়া (খেলা), চোর চোর (খেলা) এই-জাতীয় অর্থাৎ সত্যকার ঘোড়া নহে, তাহারি নকল করিয়া খেলা।

পেয়াদা আসিয়া হাজির’ তখন একেবারে চার পেয়াদা আসায় বাহুল্যজনিত বিস্ময় প্রকাশ করি। প্রদীপের সমালোচক মহাশয় বলেন, এই স্থলের দ্বিত্ব বিভক্ত-বহুলতা-জ্ঞাপক। অর্থাৎ যখন বলা হয়, ‘তাহাদিগকে ধরিবার এ চার চার জন পেয়াদা আসিয়া হাজির’, তখন সমালোচক মহাশয়ের মতে তাহাদের প্রত্যেকের জন্য চার চার পেয়াদা আসিয়া উপস্থিত ইহাই বুঝায়। আমরা এ কথায় সায় দিতে পারিলাম না। বিহারীবাবুও দৃষ্টান্ত দ্বারা দেখাইয়াছেন, একজনের জন্যও চার চার পেয়াদা বাংলাভাষা অনুসারে আসিতে পারে। বিহারীবাবু বলেন, দৃষ্টান্ত অনুসারে দুই অর্থই সংগত হয়। অর্থাৎ এক এবং বিভক্ত-বহুলতা, দু-ই বুঝাইতে পারে। তাহা ঠিক নহে— প্রকর্যই বুঝায়, সেই প্রকর্য একজনের সম্বন্ধেও বুঝাইতে পারে, ভিন্ন ভিন্ন লোকের সম্বন্ধেও বুঝাইতে পারে, সুতরাং উভয়বিধ প্রয়োগের মধ্যে প্রকর্য ভাবই সাধারণ।