পাতা:বাখতিন - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৯৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

যে বিপুল অন্ধতাকে আবৃত করে রেখেছিল, সেদিকে দৃষ্টি আকৃষ্ট হয় আমাদের। লোকায়ত জ্ঞান ও অনুভূতি সরাসরি নয়, নানা ছদ্মবেশ নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক বয়ানের রৈখিকতায় আঘাত করে। সাংস্কৃতিক প্রভুত্ববাদের দেওয়াল তাতে ভেঙে না পড়ুক, বেশ কিছু পাথর অন্তত খসে পড়ে। আর, এই গুরুত্বপূর্ণ উপলব্ধি হয় আমাদের, একমাত্রিক জাতীয় সংস্কৃতি বা মূল্যবোধ সত্য হতে পারে না কখনও। প্রান্তিকায়িত অপর পরিসরের মধ্যে অনাবিষ্কৃত রইল কিনা জনমানসের প্রকৃত নির্যাস, সামূহিক অস্তিত্বের খাঁটি প্রাণপ্রবাহ—সে-বিষয়ে আমাদের অবহিত করে বলেই তো ‘Bakhtin’s carnival idea had the thrill of a cultural and biological universal.’ (Caryl Emerson: 1997: 163)। সামাজিক জীবনের মর্মমূলে যাঁরা বহুত্ববাদী দার্শনিক বীক্ষাকে স্বতঃসিদ্ধ বলে মনে করেন, সরকারি বক্তব্যকে নির্বিকল্প মান্যতা দেওয়া তাঁদের পক্ষে সম্ভবই নয়। নৃতত্ত্ব, ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব প্রভৃতির গবেষণায় এখন প্রমাণিত যে বৃহৎ ঐতিহ্য ও লঘু ঐতিহ্য সম্মিলিত ভাবে জাতীয় সংস্কৃতির জন্ম দেয়। কিন্তু উদ্ধত আধিপত্যবাদ এই সত্যকে অস্বীকার করতে চায় বলে সমস্ত অপর পরিসরের অস্তিত্বই মুছে ফেলে এবং কোথাও কোনো বিকল্পের সম্ভাবনাও স্বীকার করে না। চূড়ান্ত এই একবাচনিকতা ও রুদ্ধতাকে মোকাবিলা করতে দেখা দেয় কার্নিভালের বিপ্রতীপায়ন। দ্রোহাত্মক এই প্রবণতাকে কেউ কেউ বলেছেন সংযোগের নতুন আকল্প; বলেছেন, এ আসলে ‘Carnival dynamics’ (তদেব)।

 এই ‘dynamics’-এর নিরিখে আপাত-প্রাতিষ্ঠানিক লিখনপ্রণালীর মধ্যেও আমরা আবিষ্কার করতে পারি ভূমিসংলগ্ন জীবনের দ্রোহ, ক্ষমতা-দম্ভ মোকাবিলার জন্যে লোকায়ত চেতনার অন্তর্ঘাত। হয়তো এতে সাময়িক কৌণিকতার চেয়ে বেশি কিছু তৈরি হয় না; তবু একবাচনিক সরকারি বয়ানই যে শেষ কথা নয়—এই উপলব্ধি অন্তত নিয়ে আসে জনপ্রিয় সাংস্কৃতিক প্রকরণ থেকে উৎসারিত বেসরকারি রচনাপুঞ্জ। তার প্রকাশ হয়তো পিনদ্ধ নয়, প্রণালীবদ্ধও নয়; তবু প্রাতিষ্ঠানিক বাচনের অভ্যস্ত ও রুদ্ধ অচলায়তনে প্রতিস্পর্ধা জানাতে এর জুড়ি নেই। একে বাখতিন বলেন কার্নিভালীকৃত লিখন-প্রয়াস—‘which has taken the carnival spirit into itself and thus reproduces within its own structures and by its own practice, the characteristic inversions, parodies and discrownings of carnival proper,’ (Simon Dentith: 1995: 65)। বাখতিনের দৃষ্টিকোন অনুসরণ করে সমালোচকেরা লক্ষ করেছেন যে সাংস্কৃতিক ইতিহাসের কিছু কিছু বিশেষ পর্যায়ে কর্তৃত্ববাদ-বিরোধী প্রবণতা আলাদা ভাবে লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। তখন সরকারি বয়ান যত দাপটের সঙ্গে উচ্চবর্গীয় অবস্থানকে পুষ্ট করুক না কেন, প্রায় অপ্রত্যাশিত ভাবেই অনালোকিত পরিসর থেকে উঠে আসে সমান্তরাল অস্তিত্বের বার্তা। তখন কোনো-একটি বিশিষ্ট সাহিত্য-প্রকরণ একচেটিয়া প্রাধান্য বিস্তার করলেও তারই ভেতর থেকে দেখা দেয় ভিন্ন ধরনের অন্তর্বয়নের ঘোষণা।

 উনিশ শতকের বাংলা সাহিত্যে স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসে তাই কখনও কখনও চোখে পড়ে সম্ভাব্য ‘carnival spirit’-এর উপস্থিতি। বিষবৃক্ষ, রজনীরাজসিংহ-এর মতো নিশ্ছিদ্র গাম্ভীর্যপূর্ণ প্রতিবেদনেও ঐ ব্যতিরেকী উপস্থিতির ইশারা রয়েছে। আর, ইন্দিরার পরিহাস, আখ্যানের বিশিষ্ট চলনে লক্ষ করি সেই বিপ্রতীপায়নের প্রকাশ। বঙ্কিমচন্দ্রের দৃপ্ত আবির্ভাবের ঠিক আগে আলালের ঘরের দুলালহুতোম প্যাঁচার নকশা

৯১