পাতা:বিদ্যাসাগর জননী ভগবতী দেবী.pdf/২৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৪
ভগবতী দেবী

কাহারও অনুরোধ রক্ষা করেন নাই। তদবধি বাস্তুভূমির নয় টাকা পাঁচ আনা কর আদায় হইয়া আসিতেছে, রামজয়ের মনোগত ভাব এই যে, নিষ্করে বাস করিলে, ভূস্বামী পুণ্যের অংশ গ্রহণ করিতে পারিবেন এবং তিনি আজন্মকাল মনে মনে অহঙ্কার করিতে পারিবেন যে, আমি উহাকে চিরকালের জন্য বাসস্থান দান করিয়াছি; একারণ নিষ্করে বাস করিতে সম্মত হইলেন না।

 “বীরসিংহে কতিপয় দিবস অতিবাহিত করিয়া, তর্কভূষণ মহাশয় জ্যেষ্ঠ পুত্র ঠাকুরদাসকে দেখিবার জন্য কলিকাতা প্রস্থান করিলেন। ঠাকুরদাসের আশ্রয়দাতার মুখে তদীয় কষ্টসহিষ্ণুতা প্রভৃতির প্রভূত পরিচয় পাইয়া, তিনি যথেষ্ট আশীর্ব্বাদ ও সবিশেষ সন্তোষ প্রকাশ করিলেন। বড়বাজারের দরমহাটায় [দয়েহাটায়] উত্তররাঢ়ীয় কায়স্থ ভাগবতচরণ সিংহ নামে এক সঙ্গতিসম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন। এই ব্যক্তির সহিত তর্কভূষণ মহাশয়ের বিলক্ষণ পরিচয় ছিল। সিংহ মহাশয় অতিশয় দয়াশীল ও সদাশয় মনুষ্য ছিলেন। তর্কভূষণ মহাশয়ের মুখে তদীয় দেশত্যাগ অবধি যাবতীয় বৃত্তান্ত অবগত হইয়া, প্রস্তাব করিলেন, আপনি অতঃপর ঠাকুরদাসকে আমার বাটীতে রাখুন, আমি তাহার আহার প্রভৃতির ভার লইতেছি; সে যখন স্বয়ং পাক করিয়া খাইতে পারে, তখন আর তাহার কোনও অংশে অসুবিধা ঘটিবে না।

 “এই প্রস্তাব শুনিয়া, তর্কভূষণ মহাশয়, সাতিশয় আহ্লাদিত হইলেন; এবং ঠাকুরদাসকে সিংহ মহাশয়ের আশ্রয়ে রাখিয়া বীরসিংহে প্রতিগমন করিলেন। এই অবধি, ঠাকুরদাসের আহারক্লেশের অবসান হইল। যথা সময়ে আবশ্যকমত, দুইবেলা আহার পাইয়া তিনি পুনর্জন্ম জ্ঞান করিলেন। এই শুভঘটনা দ্বারা, তাঁহার যে কেবল আহারের ক্লেশ দূর হইল, এরপ নহে; সিংহ মহাশয়ের সহায়তায় মাসিক আট টাকা বেতনে এক স্থানে নিযুক্ত হইলেন। ঠাকুরদাসের আট টাকা মাহিয়ানা হইয়াছে, এই সংবাদ শুনিয়া তদীয় জননী দুর্গাদেবীর আহ্লাদের সীমা রহিল না।” এই সময়ে তর্কভূষণ মহাশয় ঠাকুরদাসের বিবাহ দিলেন।

 ইহার কিয়ৎকাল পরে, একদিন রামজয়, ঠাকুরদাসকে বলিলেন, “তুমি এক্ষণে কর্ম্মক্ষম হইয়াছ, ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করিবেন, আমি ঈশ্বরের আরাধনাভিলাষী; পুনর্ব্বার তীর্থ-পর্য্যটনে যাত্রা করিতেছি।” এই কথা শুনিয়া ঠাকুরদাস অত্যন্ত দুঃখিত হইলেন। তিনি এ সংবাদ বাটীতে লিখিলেন।

 ভগবতী দেবী যৌবনসীমায় পদার্পণ করিবার পূর্ব্বেই শ্বশুরালয়ে আগমন করিলেন। মাতুলালয়ের স্বচ্ছল সংসারের সুখস্বচ্ছন্দতায় আর তাঁহার মন পরিতৃপ্ত করিতে পারিল না। তিনি স্বীয় পতির আত্মসম্মানকে এতদূর মুল্যবান মনে করিলেন যে, সন্তুষ্টচিত্তে মাতুলগৃহ ত্যাগ করিয়া পতিগৃহে নিতান্ত সাংসারিক অস্বচ্ছলতার মধ্যে বাস করিয়াও সুখে দিনযাপন করিতে লাগিলেন। সেই সময়ে, তিনি অনন্যমনে পতির চিত্তানুবর্ত্তন করিতেন, প্রত্যহ স্বহস্তে গৃহমার্জ্জনা, মৃত্তিকা দ্বারা উপলেপন, গহোপকরণ ভোজন পাত্রাদির সংস্কার, রন্ধন, যথাসময়ে