পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/৬৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

দৃষ্টি-প্রদীপ & S আছে খৃষ্টের, মেমের বড়দিনের সময় আমায় দিয়েছিল—বকের পালকের মত ধবধবে সাদা দীর্ঘ ঢিলে আলখাল্লা-পরা যীশু হাসি-হাসি মুখে দাড়িয়ে—চারিধারে তার ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ভিড় করেচে, একটি ক্ষুদ্র শিশু তার পা ধরে উঠে দাড়াতে চেষ্টা করচে, আর তিনি তাকে ধরে তুলতে যাচ্চেন নিচু হয়ে—মুখে কি অপূর্ব জ্যোতি, কি সুন্দর চাউনি—আমি এ ছবিখানা বইয়ের ভেতর রেখে দিই, রোজ একবার দেখি—এত ভালো লাগে ! কিন্তু যীশুখৃষ্টের সম্বন্ধে কোনো ভাল বই পাইনে—আমার আরও জানবার ইচ্ছে হয় তার কথা—মাকে যে মেমেরা পড়াত চা-বাগানে, তারা একখানা মথি-লিখিত সুসমাচার ও খানকতক ছাপানো কাগজ বিলি করেছিল, সেইগুলো কতবার পড়া হয়ে গিয়েচে, তা ছাড়া তার কোনো বই নেই। এখানে এসে পৰ্য্যন্ত আর কোনো নতুন বই আমার চোখে পড়েনি। আমাদের স্কুলে একটা ছেলে নতুন এসে ভৰ্ত্তি হয়েচে তামাদেরই ক্লাসে । তার নাম বনমালী, জাতে সদগোপ, রঙ খুব কালে, কিন্তু মুথের চেহার বেশ, বয়সে আমার চেয়ে কিছু বড়। সে অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে, এখানে একটা ঘর ভাড়া করে থাকে, বামুনে রাধে । অনেক দূরের পাড়াগায়ে তার বাড়ি, সেখানে লেখাপড়া শেখার কোনো সুবিধে নেই, তাই ওকে ওর বাপ-মা এই গায়ে পাঠিয়েচে । কিন্তু লেখাপড়ার দিকুে বনমালীর মন নেই, সে বাসার উঠোনে এক তুলসীচারা পুতে বাধিয়েচে, দিনরাত জপ করে, একবেলা খায় মাছমাংস ছোয় না, শ্ৰীকৃষ্ণ নাম তার সামনে উচ্চারণ করার জো নেই, তা হ'লেই তার চোখ দিয়ে জল পড়বে। রাত্রে জপের ব্যাঘাত হয় ব’লে বিকেলবেলা স্কুল থেকে গিয়ে খেয়েদেয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে বামুন ঠাকুরকে ছুটি দেয়—তার পর বসে বসে অনেক রাত পৰ্য্যন্ত জপ করে, হরিনাম করে। সে সময় কেউ কাছে গেলে সে ভারি চটে। অদ্ভুত ধরনের ছেলে বলে তাকে সকলে ভারি থেপায়—স্কুলের ছেলেরা তার সামনে 'কিষ্ট’ ‘কিষ্ট’ বলে চেচায় তার চোখে জল বেরোয় কি না দেখবার জন্তে, ওই নিয়ে মাস্টারের পর্যন্ত খিচুনি দিতে বাকী রাখে না । সেদিন তো এ্যালজেব্রার অঁক না পারার দরুন আমাদের সামনে সেকেণ্ড মাস্টার ওকে বললে—তুমি তো শুনিচি কেষ্ট নাম শুনলে কেঁদে ফেল—ত। যাও, পয়সা আছে বীপের, মঠ বানাও, মচ্ছব দেও, লেখাপড়া করবার শখ কেন ? এসব তোমার হবে না বাপু । আমি একদিন বনমালীর কাছে সন্ধ্যার সময় গিয়েছি। ও তখন একট। টুলের ওপর বসে একমনে দেওয়ালের দিকে চেয়ে বোধ হয় জপ করচে—আমায় দেখে উঠে দোর খুলে দিলে, হেসে বসতে বললে । ওকে অদ্ভুত মনে হয়, সেজন্তেই দেখা করতে গিয়েছিলাম যে তা নয় —আমার মনে হয়েছিল ও যে-রকম ছেলে, ও বোধ হয় আমার নিজের ব্যাপারগুলোর একটা মীমাংসা ক’রে দিতে পারবে। তা ছাড়া ওকে আমার ভাল লাগে খুব, ওকে ভাল মানুষ পেয়ে সবাই খেপায়, অথচ ও প্রতিবাদ করে না, অনেক সময় বোঝে না যে তারা থেপাচ্ছে, এতে আমার বড় মায়া হয় ওর ওপর । বনমালীকে জিজ্ঞেস করলাম সে কিছু দেখে কিনা। সে তামার কথা বুঝতে পারলে না, বলল—কি দেখবো ? তাকে বুঝিয়ে বললাম। না,—সে কিছু দেখে না। তারপর একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল । ঘরে একখানা ছবি ছিল, আমি সেদিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললাম—ওখানা কি তোমার ঠাকুরের ছবি ? বনমালীর গলার স্বর বদলে গেল, চোখের চাউনি অন্ত রকম হয়ে গেল। সে বললে— ঠিক বলেচ ভাই, আমার ঠাকুরের ছবি, চমৎকার কথা বলেচ ভাই—ওই তো আমার সব,