পাতা:বিভূতি রচনাবলী (নবম খণ্ড).djvu/২৩৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

१२8 বিভূতি-রচনাবলী শালবন-বেষ্টিত ক্ষুদ্র গ্রামে বসিয়া বৃদ্ধ চন্দ্র পাণ্ডার বাকা বাকী মানভূমের বাংলায় সেগুলি শুনিবার সময় মনে হুইত—এদেশে এরূপ ঘটিবে ইহা আর বিচিত্র কি ! কলিকাতা বালিগঞ্জের কথা তো ইহা নয়। f কথায় কথায় চঞ্জ পাও! একদিন বলিলেন, “চেরো পাহাডে রঙ্কিণী দেবীর মন্দির দেখেচেন ?” আমি একটু আশ্চর্ঘ্য হইয়া বুদ্ধের মুখের দিকে চাহিলাম। রক্ষিণী দেবী সম্বন্ধে এ পর্য্যন্ত আমি আর কোনো কথা কাহারও মুখে শুনি নাই, সেদিন সন্ধ্যায় আমার ছাত্রটির নিকট যাহা সামান্য কিছু শুনিয়াছিলাম, তাহা ছাড। বলিলাম, মন্দির দেখেচি, কিন্তু রঙ্কিণী দেবীর কথা জানবার জন্তে যাকেই জিগ্যেস করেচি সেই চুপ করে গিয়েচে কিংবা অন্ত কথা পেড়েচে–এর কারণ কিছু বলবেন ?” চন্দ্র পাও বলিলেন, “রঙ্কিণী দেবীর নামে সবাই ভয় খায়।” “কেন বলুন তো?” “মানভূম জেলায় আগে অসত্য বুনো জাত বাস করতো। তাদেরই দেবতা উনি। ইদানীং হিন্দুরা এসে যখন বাস করলে, উনি হিন্দুদেরও ঠাকুর হয়ে গেলেন। তখন তাদের মধ্যে কেউ মন্দির করে দিলে। কিন্তু রঙ্কিণী দেবী হিন্দু দেব-দেবীর মতো নয়, অসভ্য বন্য জাতির ঠাকুর— আগে ওষ্ট মন্দিরে নরবলি হ’ত—যাট বছর আগেও রঙ্কিণী মন্দিরে নরবলি হয়েচে । অনেকে বিশ্বাস করে রঙ্কিণী দেবী অসন্তুষ্ট হ’লে রক্ষা নেই—অপমৃত্যু আর অমঙ্গল আসবে তাহলে। এরকম অনেকবার হয়েচে নাকি । একটা প্রবাদ আছে এ অঞ্চলে, দেশে মড়ক হবার আগে রঙ্কিণী দেবীর হাতের খাড়া রক্তমাখা দেখা যেত। আমি যখন প্রথমে এদেশে আসি, সে আজ চল্লিশ বছর আগের কথা—তখন প্রাচীন লোকদের মুখে একথা শুনেছিলাম।” “রক্ষিণ দেবীর বিগ্রহ দেখেছিলেন মন্দিরে ?” “ন, আমি এসে পৰ্য্যস্ত ওই ভাঙা মন্দিরই দেখচি। এখান থেকে কারা বিগ্রহটি নিয়ে যায় অন্ত কোন দেশে। রঙ্কিণী দেবীর এসব কথা আমি শুনতাম ওই মন্দিরের সেবাইত বংশের এক বৃদ্ধের মুখে। তার বাড়ী ছিল ওই চেরো গ্রামেই। আমি প্রথম যখন এদেশে আসি— তখন তার বাড়ী অনেকবার গিয়েচি। দেবীর খাড়া রক্তমাখা হওয়ার কথাও তার মুখে শুনি। এখন তাদের বংশে আর কেউ নেই। তার পর চেরো গ্রামেও আর বহুদিন ঘাই নি—বয়েল হয়েচে, বড় বেশি কোথাও বেরই নে।” “বিগ্রহের মূৰ্ত্তি কি ?” “শুনেছিলাম কালীমূৰ্ত্তি। আগে নাকি হাতে সত্যিকার নরমূও থাকতো অসভ্যদের আমলে। কত নরবলি হয়েচে তার লেখা-জোখা নেই—এখনও মন্দিরের পেছনে জঙ্গলের মধ্যে একটা চিবি আছে—খুড়লে নরমুণ্ড পাওয়া যায়।” সাধে এদেশের লোক ভয় পায়! শুনিয়া সন্ধ্যার পরে জয়চণ্ডীতলা হইতে ফিরিবার পথে আমারই গা ছমছম করিতে লাগিল।