পাতা:বিভূতি রচনাবলী (নবম খণ্ড).djvu/৫৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চাদের পাহাড় 85 ওদের কাও দেখে শঙ্কর হেসেই খুন। পায়ের তলায় মাটিও নেই, পাথরও নেই-তাদের বদলে আছে শুধু পচা পাতা ও শুকৃনে গাছের গুড়ির স্তুপ। এই সব বনে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পাতার রাশি ঝরছে, পচে যাচ্ছে, তার ওপরে শেওলা পুরু হয়ে উঠছে, ছাতা গজাচ্ছে, তার ওপরে আবার নতুন-ঝর পাতার রাশি, আবার পড়ছে গাছের ডাল-পালা, গুড়ি । জায়গায় জায়গায় ষাট-সত্তর ফুট গভীর হয়ে জমে রয়েছে এই পত্ৰস্তৃপ। আলভারেজ ওকে শিখিয়ে দিলে, এসব জায়গায় খুব সাবধানে পা ফেলে চলতে হবে। এমন জায়গা আছে, যেখানে মানুষে চলতে চলতে ওই ঝরা পাতার রাশির মধ্যে ভূস করে ঢুকে ডুবে যেতে পারে, যেমন অতকিতে পথ চলতে চলতে প্রাচীন কূপের মধ্যে পড়ে যায়। উদ্ধার করা সম্ভব না হলে সে-সব ক্ষেত্রে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে মৃত্যু অনিবাৰ্য্য। শঙ্কর বললে—পথের গাছপালা না কাটলে আর তো ওঠা যাচ্ছে না, বড় ঘন হয়ে উঠছে। ক্ষুরের মত ধারালো চওড়া এলিফ্যান্ট, ঘাসের বন—যেন রোমান যুগের দ্বি-ধার তলোয়ার। তার মধ্যে দিয়ে যাবার সময় দুজনের কেউই নিরাপদ বলে ভাবছে না নিজেকে, দু-হাত তফাতে কি আছে দেখা যায় না যখন, তখন সব রকম বিপদের সম্ভাবনাই তো রয়েছে। থাকতে পারে বাঘ, থাকতে পারে সিংহ, থাকতে পারে বিষাক্ত সাপ। শঙ্কর লক্ষ্য করছে মাঝে মাঝে ডুগডুগি বা ঢোল বাজনার মত একটা শব্দ হচ্ছে কোথায় যেন বনের মধ্যে। কোনো অসভ্য জাতির লোক ঢোল বাজাচ্ছে নাকি? আলভারেজকে সে জিজ্ঞেস করলে | আলভারেজ বললে—ঢোল নয়, বড় বেবুন কিংবা বনমাহুযে বুক চাপড়ে ওই রকম শব্দ করে। মানুষ এখানে কোথা থেকে আসবে ? শঙ্কর বললে—তুমি যে বলেছিলে এ বনে গরিলা নেই ? —গরিলা সম্ভবতঃ নেই। আফ্রিকার মধ্যে বেলজিয়ান কঙ্গোর কিছু অঞ্চল, রাওয়েনজরী আল্পস্ বা ভিরুঙ্গ। আগ্নেয় পৰ্ব্বতের অরণ্য ছাড়া কোথাও গরিলা আছে বলে তো জানা নেই। গরিলা ছাড়াও অন্য ধরনের বনমানুষে বুক চাপড়ে ওই রকম আওয়াজ করতে পারে। ওরা সাড়ে চার হাজার ফুটের ওপর উঠেছে। সেদিনের মত সেখানেই রাত্রির বিশ্রামের জন্য তাবু ফেলা হল। একটা বিশাল সত্যিকার ট্রপিক্যাল অরণ্যের বাত্রিকালীন শব এত বিচিত্র ধরনের ও এত ভীতিজনক যে সারারাত শঙ্কর চোথের পাতা বোজাতে পারলে না। শুধু ভয় নয়, ভয় মিশ্রিত একটা বিস্ময়। * কত রকমের শব্দ–হায়েনার হাসি, কলোবাস বানরের কর্কশ চীৎকার, বনমানুষের বুক চাপড়ানোর আওয়াজ, বাঘের ডাক-প্রকৃতির এই বিরাট নিজস্ব পশুশালায় রাত্রে কেউ ঘুমোয় না। সমস্ত অরণ্যটা এই গভীর রাত্ৰে যেন হঠাৎ ক্ষেপে উঠেছে। বছর কয়েক আগে খুব বড় একটা সার্কাসের দল এসে ওদের স্কুল-বোর্ডিংয়ের পাশের মাঠে তাবু ফেলেছিল,