পাতা:বিভূতি রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড).djvu/১৭৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

১৬২ বিভূতি-রচনাবলী ধাতুরিয়াকে ছাড়িয়া দিতে মন সরে না। বলিলাম—কাছারিতে যদি কিছু জমি দিই, তবে এখানে থাকতে পারবে ? চাষবাস কর, থাক না কেন ? মটুকনাথ পণ্ডিতেরও দেখিলাম খুব ভাল লাগিয়াছে ধাতুরিয়াকে । তাহার ইচ্ছ ধাতুরিয়াকে সে টোলের ছাত্র করিয়া লয়। বলিল—বলুন না ওকে বাবুজী, দু-বছরের মধ্যে মুগ্ধবোধ শেষ করিয়ে দেব। ও থাকুক এখানে । জমি দেওয়ার কথায় ধাতুরিয়া বলিল—বাবুজী, আপনি আমার বড় ভাইয়ের মত, আপনার বড় দয়া । কিন্তু চাষ-কাজ কি আমায় দিয়ে হবে ? ওদিকে আমার মন নেই যে ! নাচ দেখাতে পেলে আমার মনটা ভারি খুশী থাকে। আর কিছু তেমন ভাল লাগে না । —বেশ, মাঝে মাঝে নাচ দেখাবে, চাষ করতে ত জমির সঙ্গে তোমায় কেউ শেকল দিয়ে বেঁধে রাখবে না ? ধাতুরিয়া খুব খুশী হইল। বলিল—আপনি যা বলবেন, আমি তা শুনব । আপনাকে বড় ভাল লাগে, বাবুজী। আমি ঝল্লুটোলা থেকে ঘুরে আসি—আপনার এখানেই আসব। মটুকনাথ পণ্ডিত বলিল—আর সেই সময় তোমাকে টোলেও ঢুকিয়ে নেব । তুমি না হয় রাত্রে এসে পড়ে আমার কাছে। মুখ থাকা কিছু নয়, কিছু ব্যাকরণ, কিছু কাব্য লব জ রাখা দরকার। ধাতুরিয়া তাহার পর বসিয়া বসিয়া নৃত্যশিল্পের বিষয় নানা কথা কি সব বলিল, আমি তত বুঝিলাম না। পূর্ণিয়ার হো-হো-নাচের ভঙ্গীর সঙ্গে ধরমপুর অঞ্চলের ঐ শ্রেণীর নাচের কি তফাৎ—সে নিজে নূতন কি একটা হাতের মুদ্রা প্ৰবৰ্ত্তন করিয়াছেন—এই সব ধরনের কথা । —বাবুজী, আপনি বালিয়া জেলায় ছট, পরবের সময় মেয়েদের নাচ দেখেছেন? ওর সঙ্গে ছক্করবাজি নাচের বেশ মিল থাকে একটা জায়গায় । আপনাদের দেশে নাচ কেমন হয় ? আমি তাহাকে গত বৎসর ফসলের মেলায় দৃষ্ট ননীচের নাটুয়ার নাচের কথা বলিলাম। ধাতুরিয়া হাসিয়া বলিল—ও কিছু না বাবুজী, ও মুঙ্গেরের গেয়ে নাচ । গাঙ্গেতাদের খুলী করবার নাচ । ওর মধ্যে খাটি জিনিস কিছু নেই। ও ত সোজা । বলিলাম—তুমি জানো ? নেচে দেখাও ত ? ধাতুরিয়া দেখিলাম নিজের শাস্ত্রে বেশ অভিজ্ঞ। ননীচের নাটুয়ার নাচ সত্যিই চমৎকার নাচিল—সেই খুং খুৎ করিয়া ছেলেমানুষের মত কান্না, সেই চোরা ননী বিতরণ করিবার ভঙ্গী—সেই সব । তাহাকে আরও মানাইল এই জন্য যে, সে সত্যিই বালক । ধাতুরিয়া বিদায় লইয়া চলিয়া গেল। যাইবার সময় বলিল—এত মেহেরবানিই যখন করলেন বাবুজী, একবার কলকাতায় কেন নিয়ে চলুন না ? ওখানে নাচের আদর আছে। এই ধাতুরিয়ার সহিত আমার শেষ দেখা ।