পাতা:বিরাজ বৌ - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৫০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৫০
বিরাজবৌ

পুঁটির বড়ো পিসশাউড়ির কি দম্প, কি তেজ মা, কাপড়খানা নিলে না, ফিরিয়ে দিলে;—বলিয়া কাপড়খানি আঁচলের ভিতর হইতে বাহির করিয়া দিল।

 এবার বিরাজ সমস্ত বুঝিল। সে একদৃষ্টে বস্ত্রখানির দিকে চাহিয়া রহিল—তাহার অন্তরে বাহিরে আগুন ধরিয়া গেল।

 নীলাম্বর বাহিরে গিয়াছিল, কত বেলায় আসিবে তাহার স্থিরতা নাই, সুন্দরী অপেক্ষা করিতে পারিল না, চলিয়া গেল।

 দুপুরবেলা নীলাম্বর আহার করিতে বসিয়াছিল, বিরাজ ঘরে ঢুকিয়া অদূরে সেই কাপড়খানা রাখিয়া দিয়া বলিল, সুন্দরী ফিরিয়ে দিয়ে গেল।

 নীলাম্বর মুখ তুলিয়া দেখিয়াই একেবারে ভয়ে ম্লান হইয়া গেল। এই ব্যাপারটা যে এমন ভাবে বিরাজের গোচরে আসিতে পারে তাহা সে কল্পনাও করে নাই। এখন কোন প্রশ্ন না করিয়া মাথা হেঁট করিয়া রহিল।

 বিরাজ কহিল, কেন তারা নিলে না, কেন গালিগালাজ করে ফিরিয়ে দিলে, সব কথা সুন্দরীর কাছে গেলেই শুনতে পাবে।

 তথাপি নীলাম্বর মুখ তুলিল না, কিংবা একটি কথাও শুনিতে চাহিল না।

 বিরাজও চুপ করিল।

 নীলাম্বরের ক্ষুধাতৃষ্ণা একেবারে চলিয়া গিয়াছিল, সে ভীত অবনতমুখে কেবলই অনুভব করিতে লাগিল,—বিরাজ তাহার প্রতি স্থিরদৃষ্টিতে চাহিয়া আছে এবং সে দৃষ্টি অগ্নিবর্ষণ করিতেছে।

 সন্ধ্যাবেলা সুন্দরীর ঘরে গিয়া সব কথা পুনঃ পুনঃ শুনিয়া নীলাম্বর কহিল, পশ্চিমে যখন বেড়াতে গেছে, তখন সে নিশ্চয় ভালই আছে, না সুন্দরী?

 সুন্দরী ঘাড় নাড়িয়া বলিল, ভাল আছে বৈ কি বাবু।

 নীলাম্বরের মুখে প্রফুল্লভাব ধারণ করিল, কহিল, কত বড়টি হয়েচে দেখলি?

 সুন্দরী হাসিয়া বলিল, দেখা ত হয়নি বাবু!

 নীলাম্বর নিজের প্রশ্নে লজ্জিত হইয়া বলিল, তা বটে, কিন্তু দাসী-চাকরের কাছেও শুনলি ত?

 না বাবু। তার পিসশাউড়ি মাগীর যে কথাবার্তা, যে হাত-পা নাড়া, তাতে আর জিজ্ঞেস করব কি, পালাতেই পথ পাইনি।

 নীলাম্বর ক্ষণকাল স্থির থাকিয়া ক্ষুব্ধ-মুখে কহিল, আচ্ছা, পুঁটি আমার রোগা হয়ে গেছে, কি একটু মোটাসোটা হয়েছে—তোর কি মনে হয়?

 প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে সুন্দরী ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছিল, সংক্ষেপে কহিল, মোটাসোটাই হয়ে থাকবে।

 নীলাম্বর আশান্বিত হইয়া উঠিল, প্রশ্ন করিল, শুনে এসেচিস কোষ করি, না?

 সুন্দরী ঘাড় নাড়িয়া বলিল, না বাবু, শুনে কিছুই আসিনি।