বিষয়বস্তুতে চলুন

পাতা:বিষবৃক্ষ-বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.djvu/১৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

or বিষবৃক্ষ ডাকিতেও পারিল না, ভাবিতেও পারিল না । অন্ধকারে ব্যজনহস্তে যেখানে তাহার পিতা জীবিতাবস্থায় শয়ান ছিলেন, এক্ষণে যেখানে তাহার শব পড়িয়াছিল, সেই খানে বায়ুসঞ্চালন করিতে লাগিল। নিদ্রাই শেষে স্থির করিল, কেন না, মরিলে কুন্দের দশা কি হইবে ? দিবারাত্রি জাগরণে এবং এক্ষণকার ক্লেশে বালিকার তন্দ্র আসিল । কুন্দনন্দিনী রাত্রি দিব জাগিয়া পিতৃসেবা করিয়াছিল। নিদ্রাকর্ষণ হইলে কুন্দনন্দিনী তালবৃন্তহস্তে সেই অনাবৃত কঠিন শীতল হৰ্ম্ম্যতলে আপন মৃণালনিন্দিত বাহুপরি মস্তক রক্ষা করিয়া নিদ্রা গেল । তখন কুন্দনন্দিনী স্বপ্ন দেখিল । দেখিল, যেন রাত্রি অতি পরিষ্কার জ্যোৎস্নাময়ী। আকাশ উজ্জ্বল নীল, সেই প্রভাময় নীল আকাশমণ্ডলে যেন বৃহচ্চন্দ্রমণ্ডলের বিকাশ হইয়াছে। এত বড় চন্দ্রমণ্ডল কুন্দ কখন দেখে নাই। তাহার দীপ্তিও অতিশয় ভাস্বর, অথচ ময়নস্নিগ্ধকর। কিন্তু সেই রমণীয় প্রকাণ্ড চন্দ্রমণ্ডলমধ্যে চন্দ্র নাই ; তৎপরিবর্তে কুন্দ মণ্ডলমধ্যবৰ্ত্তিনী এক অপূৰ্ব্ব জ্যোতিৰ্ম্ময়ী দৈবী মূৰ্ত্তি দেখিল । সেই জ্যোতিৰ্ম্ময়ী মূৰ্ত্তিসনাথ চন্দ্রমণ্ডল যেন উচ্চ গগন পরিত্যাগ করিয়া, ক্রমে ক্রমে ধীরে ধীরে নীচে নামিতেছিল। ক্রমে সেই চন্দ্রমণ্ডল, সহস্ৰ শীতলরশ্মিফুরিত করিয়া, কুন্দনন্দিনীর মস্তকের উপর আসিল । তখন কুন্দ দেখিল যে, সেই মণ্ডলমধ্যশৈাভিনী, আলোকময়ী, কিরীটকুণ্ডলাদি-ভূষণালস্কৃত মূৰ্ত্তি স্ত্রীলোকের আকৃতিবিশিষ্ট । রমণীয় কারুণ্যপরিপূর্ণ মুখমণ্ডল ; স্নেহপরিপূর্ণ হাস্ত অধরে ফুরিত হইতেছে। তখন কুন্দ সভয়ে সানন্দে চিনিল যে, সেই করুণাময়ী তাহার বহুকাল-মৃত প্রসূতির অবয়ব ধারণ করিয়াছে। আলোকময়ী সস্নেহাননে কুন্দকে ভূতল হইতে উখিত করিয়া ক্রোড়ে লইলেন । এবং মাতৃহীন কুন্দ বহুকাল পরে 'মা' কথা মুখে আনিয়া যেন চরিতার্থ হইল। পরে জ্যোতিৰ্ম্মণ্ডলমধ্যস্থা কুন্দের মুখচুম্বন করিয়া বলিলেন, “বাছা ! তুই বিস্তর দুঃখ পাইয়াছি । আমি জানিতেছি যে, বিস্তর দুঃখ পাইবি । তোর এই বালিক। বয়ঃ, এই কুসুমকোমল শরীর, তোর শরীরে সে দুঃখ সহিবে না। অতএব তুই আর এখানে থাকিস্ না । পৃথিবী ত্যাগ করিয়া আমার সঙ্গে আয়।” কুন্দ যেন ইহাতে উত্তর করিল যে, “কোথায় যাইব ?” তখন কুন্দের জননী উদ্ধে অঙ্গুলিনির্দেশ দ্বারা উজ্জলপ্রজ্বলিত নক্ষত্ৰলোক দেখাইয়া দিয়া বলিলেন যে, “ঐ দেশ।” কুন্দ তখন যেন বহুদূরবর্তী বেলাবিহীন অনন্তসাগরপারস্থবৎ, অপরিজ্ঞাত নক্ষত্ৰলোক দৃষ্টি করিয়া কহিল, “আমি অত দূর যাইতে পারিব না ; আমার বল নাই ।” তখন ইহা শুনিয়া জননীর কারুণ্য-প্রফুল্ল অথচ গম্ভীর মুখমণ্ডলে ঈষৎ অনাহলাদজনিতবৎ