পাতা:বিষাদ-সিন্ধু - মীর মোশার্‌রফ হোসেন.pdf/১১৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৯৭
মহরম পর্ব্ব—পঞ্চদশ প্রবাহ

প্রকাশ্যে কাহাকেও বারণ করিলেন না। হোসেনও সতর্ক রহিলেন। হাসনেবানুও সদাসর্ব্বদা সাবধানে থাকিতে লাগিলেন। জাএদাও মাঝে মাঝে স্বামীকে দেখিতে আসিতেন, কিন্তু জয়নাবকে স্বামীর নিকট বসিয়া থাকিতে দেখিলে আর ঘরেই প্রবেশ করিতেন না। জয়নাবের প্রতি দৃষ্টি পড়িলেই—জাএদার মুখের আকৃতির পরিবর্ত্তন হইত, বিদ্বেষানল জ্বলিয়া উঠিত, সপত্নীহিংসা বলবর্ত্তী হইত, সপত্নী-সৃষ্টিকারীর প্রতি প্রতিহিংসার আগুনে দ্বিগুণভাবে জ্বলিয়া উঠিত। স্বামী-স্নেহ, স্বামী-মমতা তাঁহার অন্তর হইতে একেবারে সরিয়া যাইত। অধর্ম্ম আচরণে প্রবৃত্তি জন্মিত। কোমল হৃদয় পাষাণে পরিণত হইত। হাসানের অকৃতি বিষবৎ লক্ষিত হইত। ইচ্ছা হইত যে তখনি—সেই মুহূর্ত্তেই হয় নিজের প্রাণ—নয় জয়নাবের, না হয় যিনি ইহার মূল তাঁহার—

 রোগীর রোগশয্যা দেখিতে কাহারও নিষেধ নাই। পীড়িত ব্যক্তিকে কেহ তত্ত্বাবধান ও সেবাশুশ্রূষা করিতে, কি দেখিতে আসিলে তাহা নিবারণ করা শাস্ত্রবহির্ভূত। একদিন জাএদার সহিত মায়মুনাও হজরত হাসানকে দেখিতে আসিল। শয্যার কিঞ্চিৎ ব্যবধানে জাএদা, তৎপার্শ্বেই মায়মুনা। তাঁহাদের নিকট অপরাপর সকলে শয্যার প্রায় চতুর্পাশ্ব ঘেরিয়া বসিয়া আছেন। মায়মুনা প্রতিবেশিনী, আর সকলেই জানিত যে, মায়মুনা এমাম-দ্বয়ের বড় ভক্ত। বাল্যকাল হইতেই মায়মুনা উভয়কে ভালবাসে; এমামদ্বয়ের জন্মদিবসে সে কতই আনন্দ প্রকাশ করিয়াছিল! জান্নাতবাসিনী জগজ্জননী বিবি ফাতেমাও মায়মুনাকে ভালবাসিতেন। মায়মুনাও তাঁহাকে ভক্তির সহিত ভালবাসিত। হাসান-হোসেনও মাতার ভালবাসার পাত্রী বলিয়া মায়মুনাকে বিশেষ ভক্তি করিতেন। মায়মুনা এতকাল পর্য্যন্ত তাঁহাদের সুখদুঃখের ভাগিনী বলিয়াই পরিচিতা ছিল। মায়মুনার মন যে কালকূট বিষম বিষে পরিপূর্ণ, তাহা জাএদা ভিন্ন আর কেহ জানিতে পারে নাই। হাসনেবানু মায়মুনাকে দুই চক্ষে দেখিতে পারিতেন না—সেটি তাঁহার স্বভাব। মায়মুনাও হাসনেবানুর প্রতি কথায় কাঁদিয়া, মাটি ভিজাইত না, সেটিও মায়মুনার স্বভাব। হাসনেবানু মুখ ফুটিয়া কোন দিন মায়মুনাকে কোন মন্দ কথা বলেন নাই,—অথচ তাঁহাকে দেখিয়া মায়মুনা হাড়ে হাড়ে কাঁপিত।