পাতা:বিষাদ-সিন্ধু - মীর মোশার্‌রফ হোসেন.pdf/১৮৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৬৭
মহরম পর্ব্ব—ত্রয়োবিংশ প্রবাহ

 ভ্রাতৃদ্বয় কোটর হইতে সজলনয়নে বাহির হইয়া পরিচারিকার সঙ্গে সঙ্গে চলিলেন। দয়াবতী নারী বালকদ্বয়কে গাত্রবস্ত্রের আবরণে ঢাকিয়া আপন কর্ত্রীর নিকটে লইয়া গেলেন।

 বালকদ্বয়ের কথা কুফা নগরে গোপন নাই। দ্বারে দ্বারে ঢেঁড়রা দেওয়া হইয়াছে—ধরিয়া দিতে পারিলেই পাঁচ সহস্র মোহর পুরস্কার, আশ্রয় দিলে তখনই শুলের অগ্রভাগে আশ্রয়দাতার প্রাণের শেষ,—তাহাতে দ্বিতীয় আদেশের অপেক্ষা নাই। গৃহকর্ত্রী এসকল জানা সত্ত্বেও দুই ভাইয়ের মস্তকে চুমা দিয়া অঞ্চল দ্বারা তাহাদের চক্ষুজল মুছাইয়া বলিতে লাগিলেন,—“বাবা! তোরা ‘এতিম’। তোদের প্রতি যে দয়া করিবে, তাহার ভাল ভিন্ন কখনই মন্দ হইবে না। আয় বাবা, আয়! আমি তোদের মা, মায়ের কোল থেকে কেউ তোদের ছিনাইয়া লইতে পারিবে না। তোদের এই মায়ের প্রাণ দেহে থাকিতে তোদের দুইজনকে কেহ লইতে পারিবে না। আয়! তোদের খুব নির্জ্জন গৃহে লইয়া রাখি। খোদা তোদের রক্ষক।” গৃহিণী দুই ভ্রাতাকেই বিশেষ যত্নে এক নির্জ্জন গৃহে রাখিলেন, বিছানা পাতিয়া দিয়া তাহাদিগকে কিছু আহার করাইলেন। প্রাণের ভয়ে ক্ষুধা-তৃষ্ণা থাকিলেও খায় কে? গৃহকর্ত্রী আপন পেটের সন্তানের অনিচ্ছায় যেমন মুখে তুলিয়া দিয়া আহার করান, সেইরূপে খাদ্যসামগ্রী হাতে তুলিয়া ভ্রাতৃদ্বয়ের মুখে দিতে লাগিলেন। আহার শেষ হইলে বলিলেন, “বাবা! তোমরা কথাবার্ত্তা বলিও না। চুপ করিয়া এই বিছানায় শুইয়া ঘুমাও। পুনঃ আহারের সময় উপস্থিত হইলে আমি আসিয়া তোমাদিগকে জাগাইয়া খাওয়াইব। তোমরা ঘুমাও, সারা রাত জাগিয়াছ, আর কত হাঁটাই হাঁটিয়াছ—ঘুমাও, কোন চিন্তা করিও না।”

 যে বাড়ীর কর্ত্রী দয়াবতী, পরিচারিকাগণও প্রায় তাঁহারই অনুরূপ হইয়া থাকে। দেখা গেল-বালকদ্বয়ের কথা কর্ত্রী আর পরিচারিকা ভিন্ন কেহই জানিতে পারিল না।

 বাটীর কর্ত্তার নাম হারেস্। কর্ত্তা বাটীতে ছিলেন না; কার্য্যবশতঃ প্রত্যুষেই নগরমধ্যে গমন করিয়াছিলেন। দিন গত করিয়া রাত্রি এক প্রহর পরে, তিনি আধমরার মত হইয়া বাটীতে আসিলেন। গৃহিণী বিলম্বের কারণ