পাতা:বিষাদ-সিন্ধু - মীর মোশার্‌রফ হোসেন.pdf/১৯০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৭১
মহরম পর্ব্ব—ত্রয়োবিংশ প্রবাহ

 “তুমি বুঝিবে কি? যাহাদের শরীর কিছুতেই সমানভাবে ঢাকে না— হাজার ঢাক, হাজার বেড় দেও —অসমান থাকিবেই থাকিবে, তাহারা জগৎ সংসারের কি বুঝিবে? তুমি বােঝ—প্রথম, অলঙ্কার,—তাহার পর টাকা-পয়সা, তাহার পর স্বামীকে একহাতে রাখা। আর কি বােঝ? মােস্‌লেমের ছেলে দুইটির মাথা কাটিবে রাজা জেয়াদ! তাহাতে তােমার চক্ষে জল আসে কেন? পরের ছেলের মাথা পরে কাটিবে, আমাদের কি? রাজা জেয়াদ মােস্‌লেমকে প্রাণে মারিয়াছে, তাহার ছেলে দুইটিকেও মারিয়া ফেলুক, ছেলের মাকে ধরিয়া আনিয়া হয় প্রাণে মারুক—না হয় ভালবাসিয়া রাণী করিয়া অন্তঃপুরে রাখুক,—তােমার আমার কি? মাঝখানে আমার পাঁচটি হাজার মােহর লাভ হইবে। এ কার্য্যে চেষ্টা করিব না? তােমার অঞ্চল ধরিয়া—চেনা নাই, জানা নাই, মােস্‌লেমের জন্য-—তাহার দুইটি পুত্রের জন্য কাঁদিতে থাকিব? এরূপ বুদ্ধি আমার হইলে আর চাই কি?—সংসার টন্‌টনে— খাসা!—একেবারে কাবার! শুন কথা: ছেলে দুইটি যাহার চক্ষে পড়িবে, সেই-ই ধরিবে। ধরিলেও নিশ্চিন্ত নহে। বাধা বিঘ্ন অনেক। কত লােক ছুটাছুটি করিতেছে। কত গুণ্ডা ঐ খোঁজে বাহির হইতেছে। কাহার হাত হইতে কে কাড়িয়া লইয়া বাদশাহের দরবারে দাখিল করিবে—তাহা কে জানে? ধরিতে পারিলেও সাফল্যের আশা অতি কম! যাহা হউক, শুন আমার মনের কথা: যদি ছেলে দুইটিকে হাতে পাই—আর নিরাপদে জেয়াদ-দরবারে লইয়া যাইতে পারি— আর তােমার ভাল হউক— যদি পাঁচ হাজার মােহর পাই, তিন হাজার মােহর ভাঙ্গিয়া মাথা হইতে পা পর্য্যন্ত, আবার পা হইতে মাথা পর্য্যন্ত ডবল পেঁচে সােণা দিয়া তােমার এই সুন্দর দেহখানি একেবারে মোড়াইয়া দিব। দেখ ত, এখন লাভ কত?”

 গৃহিণী অতিশয় বিষণ্ণভাবে স্বামীর মুখ-চোখপানে চাহিয়া বলিতে লাগিলেন,—“দেখ! আমি তােমার কথায় বাদ-প্রতিবাদ করিব না। বাধা দিতেও চাহি না তােমাকে উপদেশ দিবার ক্ষমতাও আমার নাই। আমি তােমার নিকট মিনতি করিয়া বলিতেছি, সবিনয়ে প্রার্থনা করিতেছি, তুমি মােস্‌লেমের সেই ছেলে দুইটির সন্ধানে আর যাইও না—ইহাই প্রার্থনা।