পাতা:বিষাদ-সিন্ধু - মীর মোশার্‌রফ হোসেন.pdf/১৯২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৭৩
মহরম পর্ব্ব—ত্রয়ােবিংশ প্রবাহ

স্ত্রীর বিরোধী হইতে পারেন! আর একটি গোলের কথা, স্বামীর সঙ্গে বালক দুইটি লইয়া কথান্তর হইলে পাড়াপ্রতিবেশী সকলেই জানিবে। ভাল করিতে কেহ আগে বাড়িতে চাহে না, কিন্তু মন্দ করিতে কোমর বাঁধিয়া দৌড়াইতে থাকে। রাজদরবারে যাইয়া বলিলেই হইল—অমুকের ঘরে ছিল—অমুক স্ত্রীলোকের আশ্রয়ে ছিল। আর প্রাণের আশা কি!—এই সকল কথা ভাবিয়া চিন্তিয়া তিনি আরও দুইটি লোকের সহিত পরামর্শ করিয়া কার্য্য করাই স্থির করিলেন।

 এক জন তাঁহার গর্ভজাত পুত্র;—বুদ্ধিমান বিচক্ষণ-দয়ার শরীর। শরীরে পিতার গুণ অল্প ছিল, মাতার গুণ অধিক। সেই এক জন, আর একজন, তাঁহার গর্ভজাত পুত্র নহে,—পালিত পুত্র। শৈশবকাল হইতে আপন স্ত্ন্য পান করাইয়া তিনি তাহাকে প্রতিপালন করিয়াছেন। সেই পালিত পুত্র তাঁহার সম্পূর্ণ গুণের অধিকারী হইয়াছে। সেই-ই তাঁহার সম্পূর্ণ বিশ্বাসী। আপন গর্ভজাত পুত্র তাহার পিতা হারেসের কথা অমান্য করিতে পারে না। অন্যায় কার্য্য হইলেও প্রতিবাদ করে না,—চুপ করিয়া নীরব থাকে। পালিত পুত্রটি তাহা নহে। সে জননীর অনুগত—বাধ্য। হারেসের কথা সে শুনে না। হারেস কোন অন্যায় কথা বলিলে, সে অকপটে নির্ভয়ে তাহার প্রতিবাদ করে। তাহার মনের ধারণাই এই,‘যাঁহার শরীরের শোণিতে আমার জীবন রক্ষা হইয়াছে, দেহ বৃদ্ধি হইয়াছে, যাঁহার স্নেহ-মমতা, অনুগ্রহে আমি এত বড় হইয়াছি, তিনিই আমার সর্ব্বস্ব—তিনিই আমার পূজনীয়া। তিনিই আমার মুক্তিদাত্রী মাতা—মাতাই আমার সম্বল—মাতাই আমার বল।

 হারেস-জায়া নিশীথ সময়ে দুই পুত্রকেই চুপি চুপি ডাকিলেন; অন্য কক্ষে আনিয়া অতি নির্জ্জন স্থানে তাহাদিগকে সম্মুখে রাখিয়া বসিলেন।

 পালিত পুত্রকে বলিলেন, “বাবা। তুই আমার পেটে না জন্মিলেও আমি তোকে আমার বুকের দুধ দিয়া প্রতিপালন করিয়াছি। কত মল-মুত্র এই হাতে পরিষ্কার করিয়া তোকে বাঁচাইয়াছি। বাবা! তুই আমার শরীরের সার অংশ দ্বারা প্রতিপালিত হইয়াছিস। আমার শরীরের রক্ত-মাংসে তোর দেহপুষ্টি হইয়াছে।” পরে আপন গর্ভজাত সন্তানের হস্ত ধরিয়া বলিলেন, “বাবা!