পাতা:বিষাদ-সিন্ধু - মীর মোশার্‌রফ হোসেন.pdf/১৯৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বিষাদ-সিন্ধু
১৮০

চলিয়া যাইতেছে। নদীতীরে পিতৃহারা অনাথ দুইটি বালক, কৃপাণধারী যমদুত-সম্মুখে দণ্ডায়মান হইয়া কতরকণ্ঠে বলিতেছেন, “ওগো! আমাদিগকে প্রাণে মারিও না।” তাঁহারা প্রাণের দায়ে হন্তার পদতলে লুটাইয়া কাঁদিতে কাঁদিতে বলিতেছেন, “আমরা দুঃখিনীর সন্তান। জনমের মত পিতাকে এই দেশে হারাইয়াছি। মায়ের মুখখানি দেখিব। তোমার নিকটে প্রাণভিক্ষা চাহিতেছি— আমাদের প্রাণভিক্ষা দাও। আমরা জীবনে আর কুফায় আসিব না।”

 বালক দুইটি কতই অনুনয় বিনয় করিলেন—হারেসের মন গলিল না। হারেসের সম্মুখে বধ্যভূমে বালকদ্বয় দণ্ডায়মান। বাম পার্শ্বে হায়েসের দুই পুত্র,—বিষণ্ণবদনে দণ্ডায়মান। দয়াবতী হারেস-জায়াও পুত্রদ্বয়ের পশ্চাৎ—মোস্‌লেম-পুত্রদ্বয়ের প্রতি একদৃষ্টে চাহিয়া স্বামী-ভয়ে নীরবে কাঁদিয়া চক্ষুজলে ভাসিতেছেন। হারেস এক একবার তরবারি উত্তোলন করেন, আবার থামিয়া যান। একবার বালকদ্বয়ের মুখের দিকে, তৎপরেই ফোরাতের জলস্রোতের দিকে চাহিয়া ঊর্দ্ধে দৃষ্টি করেন। এইরূপে ক্রমেই বিলম্ব হইতে লাগিল।

 হারেস যেন বিরক্ত হইয়া পালিত পুত্রকে বলিলেন,—“পুত্র! ধর ত আমার এই তরবারি। আজ দেখিব তোমার তরবারির হাত। এক আঘাতে দুইটি বালকের মাথা মাটিতে গড়াইয়া দাও দেখি।”

 পুত্র উত্তর করিল, “পিতঃ! আমাকে ক্ষমা করিবেন। আমি উহা পারিব না। নিষ্পাপ, নিরপরাধ, দোষশূন্য দুইটি পিতৃহীন অনাথ বালককে, টাকার লোভে বধ করিতে পারিব না—কখনই পারিব না। বালকদ্বয়ের প্রাণ রক্ষা করিতে যাহা আবশ্যক তাহা করিব। আমার প্রাণ দিব, তথাপি ঐ বালকদ্বয়ের প্রতি কোনরূপ অত্যাচার হইতে দিব না। আপনার এ অবৈধ আদেশ কখনই প্রতিপালন করিব না। টাকার লোভে মানুষ খুন, এ মানুষের কার্য্য নহে—ডাকাত! ডাকাত!”

 হারেস রোষ-কষায়িত লোচনে রক্ত আঁখি ঘুরাইতে ঘুরাইতে বলিতে লাগিলেন,—“কি রে পামর! আমার কার্য্য তোর চক্ষে হ’ল অবৈধ? তোর এত বিচারে কাজ কি? আর এত লম্বা-চওড়া কথা তুই কার কাছে