পাতা:বিষাদ-সিন্ধু - মীর মোশার্‌রফ হোসেন.pdf/২৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বিষাদ-সিন্ধু

সে ফাঁদে জগতের অনেক ভাল লোক বাঁধা পড়িয়াছেন। শত শত মুনি-ঋষি, ঈশ্বরভক্ত কত শত মহাতেজস্বী, জিতেন্দ্রিয়, মহাশক্তিবিশিষ্ট মহাপুরুষ এই ফাঁদে পড়িয়া তত্ত্বজ্ঞান হারাইয়াছেন, তাহার সংখ্যা নাই। আসক্তি, প্রেম ও ভালবাসার কথা ধর্ম্মপুস্তকেও রহিয়াছে। ভাবিয়া দেখিলে প্রতীত হয়, মানুষের মনেই ভালবাসার জন্ম; ইহাকে শিক্ষা দিতে হয় না, দেখাদেখিও কেহ শিক্ষা করে না, ভালবাসা স্বভাবতঃই জন্মে। বাদশা নামদার! ইহাতে নূতন কিছুই নাই। আপনি যদি মনোযোগ দিয়া শুনেন, তবে আমি এই প্রণয়প্রসঙ্গ অনেক শুনাইতে পারি, দৃষ্টান্ত দ্বারা দেখাইতেও পারি। জগতে শত শত ভালবাসার জন্ম হইয়াছে, অনেকেই ভালবাসিয়াছে, তাহাদের কীর্ত্তিকলাপ আজ পর্য্যন্ত কেন, জগৎ বিলয় না হওয়া পর্য্যন্ত মানবহৃদয়ে সমভাবে অঙ্কিত থাকিবে। বলিবেন, পাত্রাপাত্র বিবেচনা চাই। ভালবাসারূপ সমুদ্র যখন হৃদয়াকাশে মানসচন্দ্রের আকর্ষণে স্ফীত হইয়া উঠে, তখন আর পাত্রাপাত্র জ্ঞান থাকে না। পিতা, মাতা, সংসার, ধর্ম্ম, এমন কি ঈশ্বরকেও মনে থাকে কিনা সন্দেহ। ইহাতে এজিদের দোষ কি বলুন দেখি? এই নৈসর্গিক কার্য্য নিবারণ করিতে এজিদের কি ক্ষমতা আছে? না, আমার ক্ষমতা আছে? না, আপনারই ক্ষমতা আছে? যাহাই বলুন মহারাজ। ভালবাসার ক্ষমতা অসীম।

 মাবিয়া বলিলেন, “আমি কি ভালবাসার দোষ দিতেছি? ভালবাসা ত ভাল কথা। মানব-শরীর ধারণ করিয়া যাহার হৃদয়ে ভালবাসা নাই, সে কি মানুষ? প্রেমশূন্য হৃদয় কি হৃদয়? এজিদের ভালবাসা ত সেরূপ ভালবাসা নয়। তুমি কিছুই বুঝিতে পার নাই।” মহিষী কহিলেন, “আমি বুঝিয়াছি, আপনি বুঝিতে পারেন নাই। দেখুন মহারাজ, আমার এই অবস্থাতেই ঈশ্বর সদয় হইয়া পুত্র দিয়াছেন। এ জগতে সংসারী মাত্রেই পুত্র কামনা করিয়া থাকে। বিষয়-বিভব ধন-সম্পত্তি অনেকেরই আছে; কিন্তু উপযুক্ত পুত্ররত্ন কাহার ভাগ্যে কয়টি ফলে বলুন দেখি? পুত্রকামনায় লোকে কি না করে? ঈশ্বরের উপাসনা, ঈশ্বরভক্ত এবং ঈশ্বরপ্রেমিক লোকের অনুগ্রহের প্রত্যাশা, যথাসাধ্য দীনদুঃখীর ভরণপোষণে সাহায্য প্রভৃতি যত প্রকার সৎকার্য্যে মনের