পাতা:বিষাদ-সিন্ধু - মীর মোশার্‌রফ হোসেন.pdf/৩৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বিষাদ-সিন্ধু
১৮

করা হইতেছে, তাহা বড় ভয়ঙ্কর। বৃটিশ-বিধিও যদি এই ধর্ম্মসংক্রান্ত এবং শাস্ত্রসঙ্গত ব্যাপারে কেবলমাত্র স্বীকার-উক্তির জন্যই যথার্থ টাকার দায়িত্ব স্বীকারের অপরাধে স্বামীকে দায়ী করিয়া তাহার পৈত্রিক সম্পত্তি, আবাসভূমি বিক্রয়, পরিশেষে দেহ পর্য্যন্ত বন্দিশ্রেণীর সহিত কারাগারে আবদ্ধ করিয়া যথেচ্ছ ব্যবহার করিতে থাকেন; তবে তাহা নিতান্ত আক্ষেপের বিষয়। আমাদেরও দোষ না আছে, এরূপ নহে। আপন আপন দুহিতার ভবিষ্যৎ হিত কামনায় আমরা ক্রমে “মোহরানার” সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি করিতেছি! যাঁহারা ঐহিক, পারত্রিক উভয় রাজ্যের রাজা, সেই প্রভু মোহাম্মদের পরিবারগণের মোহরানার সংখ্যা এত অল্প ছিল যে, পাঠকগণ শুনিয়া আশ্চর্য্যান্বিত হইবেন। প্রভু মোহাম্মদের কন্যা, হাসান-হোসেনের জননী বিবি ফাতেমার দেনমোহর আধুনিক পরিমাণ মুদ্রার হিসাব-অনুসারে চারি টাকা চারি আনার বেশী ছিল না।

 পাত্রীর সম্মতিসূচক স্বীকারবাক্য স্বকর্ণে শ্রবণ করিবার জন্য প্রতিনিধি মহাশয় সাক্ষীসহ অন্তঃপুরে প্রবেশ করিলেন। কিছুক্ষণ পরে তাঁহারা সভায় প্রত্যাগত হইয়া জাতীয় রীত্যনুসারে সভাস্থ সভ্যগণকে অভিবাদনপূর্ব্বক কহিলেন, “বিবি সালেহা এ বিষয়ে অসম্মত নহেন, কিন্তু তাঁহার একটি কথা আছে। সে কথা এই যে, তিনি লোক-পরম্পরায় শুনিয়াছেন, এই মাননীয় সন্ত্রান্ত আবদুল জব্বার সাহেবের জয়নাব নামে একটি স্ত্রী আছেন, ধর্ম্মানুসারে জয়নাবকে পরিত্যাগ না করিলে তিনি এ বিবাহে সম্মতি দান করিতে পারেন না।” আরও তিনি বলিলেন, “জয়নাবের যত দেনমোহরের জন্য আবদুল জব্বার দায়ী, তাহার পরিমাণ তিনি জানিতে চাহেন ও জয়নাবের ভরণ-পোষণের জন্য অতিরিক্ত আরও সহস্র মুদ্রা প্রদানেও তিনি প্রস্তুত আছেন।” এই প্রস্তাবে হয়ত অনেকেরই মস্তক ঘুরিয়া যাইত, চিন্তাশক্তির পরীক্ষা হইত, আন্তরিক ভাবেরও পরীক্ষা হইত, কিন্তু আবদুল জব্বারের বিবেচনাশক্তি এতদূর প্রবল যে, তিনি অগ্রপশ্চাৎ ভাবিবার জন্য তাঁহার চিন্তাশক্তিকে ক্ষণকালের নিমিত্ত বিচলিত করিলেন না। যেমনি প্রশ্ন তেমনি উত্তর।

 আবদুল জব্বার বলিলেন, “আমি সম্মত আছি। মুখের কথা কেন, তালাকনামা (স্ত্রী-পরিত্যাগ-পত্র) এখনই লিখিয়া দিতেছি।”