পাতা:বিষাদ-সিন্ধু - মীর মোশার্‌রফ হোসেন.pdf/৪০০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৩৭৯
উদ্ধার পর্ব্ব—চতুর্ব্বিংশ প্রবাহ

প্রাণবধ দেখিব, কাল মোহাম্মদ হানিফার খণ্ডিতশির দামেস্ক-প্রান্তরে লুটাইতে দেখিব। জয়নাল আবেদীন কারাগার সম্মুখে দণ্ডায়মান ছিল; প্রহরিগণ কে কোথায় আছে, দেখিতে পাইলাম না। জয়নাল ঐ জনতার মধ্যে মিশিয়া তাহাদের সঙ্গে চলিয়া গেল। আমি সঙ্কেতে অনেক নিষেধ করিলাম—শুনিল না। একবার ফিরিয়া তাকাইয়াই উর্দ্ধশ্বাসে বেগে চলিয়া গেল। কেবলমাত্র একটি কথা শুনিলাম—‘হায় রে অদৃষ্ট! কারবালার ঘটনা এখানেও ঘটিতে আরম্ভ হইল! এক একটি করিয়া এজিদ হস্তে,—’এই কথা শুনিয়া আর কিছুই শুনিতে পাইলাম না, দেখিতে দেখিতে সে চক্ষুর অন্তরাল হইয়া পড়িল।—এ আবার কি ঘটনা ঘটিল?”

 শাহ্‌রেবানু জয়নাবের মুখপানে একদৃষ্টে চাহিয়া কথাগুলি শুনিলেন, তাঁহার মুখের ভাব সে সময় যে প্রকার হইয়াছিল, তাহা কবির কল্পনার অতীত,—চিন্তার বহির্ভূত। জয়নাল আবেদীনই তাঁহাদের একমাত্র ভরসা। শাহ্‌রেবানুর প্রাণপাখী সে সময় দেহপিঞ্জরে ছিল কি-না, তাহা কে বলিতে পারে? তাঁহার চক্ষু স্থির!—কণ্ঠরোধ! সেই এক প্রকার ভাব—স্পন্দনহীন!

 সালেমা বিবি বুদ্ধিমতী, তাঁহার সহ্যগুণ অধিক। কিন্তু শাহ্‌রেবানুর অবস্থা দেখিয়া তিনিও বিহ্বল হইলেন। শাহ্‌রেবানুর নাম ধরিয়া তিনি অনেকবার ডাকিলেন। কিন্তু শাহ্‌রেবানুর চৈতন্য নাই। তিনি শাহ্‌ৱেবানুর বুকে মুখে হাত দিয়া সান্ত্বনা দিবার অনেক চেষ্টা করিলেন, কিন্তু তাঁহার মোহ ভঙ্গ হইল না, তিনি মৃত্তিকায় পড়িয়া গেলেন। অনেকক্ষণ পরে দীর্ঘনিঃশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া শাহ্‌রেবানু বলিলেন, “জয়নাল, বাবা জয়নাল! নিরাশ্রয়া দুঃখিনীর সন্তান! কোথায় গেলি বাপ্? তোর পায় পায় শত্রু, পায় পায় বিপদ! আমরা চিরবন্দী। দুঃখের ভার বহন করিতেই জগতে আমাদের সৃষ্টি হইয়াছিল। তুই দুঃখিনীর সন্তান, কি কথা মনে করিয়া কোথায় গেলি? তুই কি তোর পিতৃব্য ওমর আলীর প্রাণবধ দেখিতে গিয়াছিস? তুই সেই বধ্যভূমিতে গিয়া কি করিবি? তোকে যে চিনিবে, সেই-ই এজিদের নিকট লইয়া গিয়া তোকেও ওমর আলীর সঙ্গী করিবে।