পাতা:বিষাদ-সিন্ধু - মীর মোশার্‌রফ হোসেন.pdf/৪০৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বিষাদ-সিন্ধু
৩৮২

অর্ধের লালসায় কত লোক বিনা বেতনে এজিদ পক্ষে মিশিতেছে। অপরিচিত বিদেশী বোধে যাহাদিগকে গ্রহণ করিতে মারওয়ানের অমত হইতেছে, তাহাদের কেহ কেহ স্ব স্ব গুণ দেখাইয়া, কেহ বা বাহুবলের পরিচয় দিয়া সৈন্যশ্রেণীতে প্রবেশ করিতেছে। কেহ বা কোন সৈন্যাধ্যক্ষকে অর্থে বশীভূত করিয়া তাহার উপরোধে প্রবেশপথ পরিষ্কার করিয়া লইতেছে। সকলেই যে সমরক্ষেত্রে শত্রুর সম্মুখীন হইবে, তাহা নহে। জয়ের ভাগ, যশের অংশ গ্রহণ করাই অনেকের অন্তরের নিগূঢ় আশা। আজ ওমর আলীয় জীবনশেষ, কাল হানিফার পরমায়ু-শেষ, যুদ্ধের শেষ—এই বিশেষ তত্ত্বেই স্বদেশী বিদেশী বহু লোকের সৈন্যদলে প্রবেশ! আবার ইহাও অনেকের মনে,—যদি বিপদের সূচনা হয়, পরাজয়ের লক্ষণ দেখা যায়, তবে ভবের ভাব, প্রকৃতির স্বভাব, সময়ের তাৎপর্য্য দেখাইয়া তাহারা ক্রমে সরিতে থাকিবে। কিন্তু জয়ের সম্ভাবনাই অধিক। ওমর আলীর প্রাণবধ ও হানিফার দক্ষিণ বাহু ভগ্ন,—একই কথা। একা হানিফার এক হস্ত কি করিবে? তাই জয়ের আশাই অধিক। এজিদের ভাগ্যবিমানে সুবায়ু-প্রতিঘাতে কালমেঘের অন্তর্দ্ধান অতি নিকট। এজিদ-শিবিরের চতুষ্পার্শ্বে বিষম জনতা—সকলের দৃষ্টিই শূলদণ্ডের সূক্ষ্ম অগ্রভাগে।

 ওদিকে মোহাম্মদ হানিফার প্রাণ ওষ্ঠাগত, বন্ধুবান্ধব আত্মীয়-স্বজনের কণ্ঠ শুষ্ক, সৈনিক-দলে মহা আন্দোলন —“হায়! হায়!! এমন বীর বিপাকে মারা পড়িল!—ভ্রাতৃআজ্ঞা প্রতিপালন করিতে অকালে কালের হস্তে নিপতিত হইল! কি সর্ব্বনাশ। ‘এজিদের প্রতি অস্ত্র নিক্ষেপ করিও না’—এই কথাতেই ওমর আলী কিশোর বয়সে শত্রুহস্তে শূলে বিদ্ধ হইতে চলিলেন। ধন্য রে ভ্রাতৃভক্তি। ধন্য রে স্থির প্রতিজ্ঞা! ধন্য আজ্ঞাপালন! ধন্য ওমর আলী!”

 সমরক্ষেত্রে প্রবেশ করিয়া সৈন্য সংগ্রহ করা বড় বিষম ব্যাপার। বিপদকালেই দূরদর্শিতার পরিচয়, ভবিষ্যৎ জ্ঞানের পরিচয়ের পরীক্ষা হয়। সুখের সময় দুশ্চিন্তা, ভবিষ্যৎ ভাবনা প্রায় কোন মস্তকই বহন করিতে ইচ্ছা করে না।