পাতা:বিষাদ-সিন্ধু - মীর মোশার্‌রফ হোসেন.pdf/৪৮২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৪৬১
এজিদ বধ পর্ব্ব—দ্বিতীয় প্রবাহ

আঘাতে কত দিন শরীরের বেদনা থাকে? ভ্রাতাগণ! এরূপ আঘাত হৃদয়ে লাগিয়াছে যে, সে বেদনা এ দেহ থাকিতে উপশম হইবে না, প্রশান্ত হইলেও, এ প্রাণ হইতে সে নিদারুণ আঘাতের চিহ্ন সরিয়া যাইবে কি না, —জানি না। আপনারা চক্ষে দেখেন নাই, বোধ হয়, বিশেষ করিয়া শুনিতে অবসরও পান নাই—এক বিন্দু জলের জন্য কত বীর বিঘোরে কাফেরের হস্তে প্রাণ হারাইয়াছে। কত সতী পুত্রধনে-স্বামীরত্নে বঞ্চিত হইয়া নীরসকণ্ঠে আত্মবিসর্জ্জন করিয়াছে, খঞ্জরের সাহায্যে সেই জ্বালা-যন্ত্রনা নিবারণ করিয়াছে! কত বালকের কণ্ঠ শুষ্ক হইয়া “জল জল” রব করিতে করিতে কণ্ঠরোধ এবং বাক্‌রোধ হইয়াছে—আভাসে, ইঙ্গিতে জলের কথা মনের সহিত প্রকাশ করিয়া জগৎ কাঁদাইয়া কত বালক জগৎ ছাড়িয়া গিয়াছে। ভ্রাতাগণ! আর কত শুনিবেন? আমাদের প্রতি লোমকূপে, প্রতি রক্তবিন্দুতে এজিদের অত্যাচার-কাহিনী জাগিতেছে। মদিনার সিংহাসনের দুর্দ্দশা, রাজ-পরিবারের বন্দীদশা, তাঁহাদের প্রতি অত্যাচার—অবিচারের কথা শুনিয়া আমরা বুদ্ধি হারাইয়াছি; আজরাইল[১]সম্মুখে বক্ষ পাতিয়া দিয়াছি; মৃত্যুমুখে দণ্ডায়মান হইয়াছি।”

 “ঈশ্বর মহান, তাঁহার কার্য্য ও মহৎ! কোন্ সূত্রে কোন সময়ে কাহার প্রতি তিনি কি ব্যবস্থা করেন, তাহা তিনিই জানেন। মদিনার বীরশ্রেষ্ঠ কাসেমের শোক কি আমরা ভুলিয়াছি? প্রভু হোসেনের কথা কি আমাদের মনে নাই? প্রভু-পরিবার এখনও বন্দীখানায়। নূরনবী মোহাম্মদের প্রাণতুল্য প্রিয় পরিজন এখনও এজিদের বন্দীখানায় আবদ্ধ —এ কি শুনিবার কথা! না—চক্ষে দেখিবার কথা! মার কাফের, জ্বালাও নগর—সকলেই আসুন আমাদের সঙ্গে।”

 এই সকল কথা কহিয়া নগরের পথে পথে, দলে দলে, মার মার শব্দে হানিফার সৈন্যগণ ছুটিল। গাজী রহ্‌মান, মস্‌হাব কাক্কা প্রভৃতি জয়নাল আবেদীনকে লইয়া প্রকাশ্য রাজপথে চলিয়াছেন! রাজপুরী নিকটবর্ত্তী, বন্দীগৃহ কিছুদূরে। গাজী রহ্‌মানের আজ্ঞায় সকলের গমনবেগ ক্ষান্ত


  1. স্বর্গীয় দুতের নাম। যিনি জীবের প্রাণ হরণ করেন তাঁহারই নাম আজরাইল।