পাতা:বিষাদ-সিন্ধু - মীর মোশার্‌রফ হোসেন.pdf/৯০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৭১
মহরম পর্ব্ব—দ্বাদশ প্রবাহ

অভাবের নামও কেহ মুখে আনিত না। তোমার কথাও রহিল, আমার কথাও থাকিল। রাত্রিও প্রায় শেষ হইয়া আসিল। ঐ দেখ শুকতারা পূর্ব্ব গগনে দেখা দিয়াছে। শীঘ্র শীঘ্র নগরমধ্যে যাওয়াই উচিত। আমি তোমার বাটীর সন্ধান লইয়াছি। আবশ্যক মত যাইব এবং গুপ্ত পরামর্শ আবশ্যক হইলে, নিশীথসময়ে উভয়ে এই গিরিগুহার সন্নিকটে আসিয়া সমুদয় কথাবার্ত্তা কহিব ও শুনিব।”

 এই বলিয়া মারওয়ান বিদায় লইলেন। মায়মুনাও বাটিতে ফিরিল। গৃহমধ্যে শয্যার উপর বসিয়া মোহরগুলি দীপালোকে এক এক করিয়া গণিয়া যথাস্থানে স্থাপনপূর্ব্বক আপনা আপনি বলিতে লাগিল,—

 “হাসান আমার কে? হাসানকে মারিতে আর আমার দুঃখ কি? আর ইহাও এক কথা, আমি ত নিজে মারিব না; আমি কেবল উপলক্ষ মাত্র। আমার পাপ কি?” মনে মনে এইরূপ আন্দোলন করিতে করিতে মায়মুনা শয়ন করিল।

 রাত্রি প্রভাত হইল। নগরস্থ উপাসনা-মন্দিরে প্রভাতী উপাসনার জন্য ভক্তবৃন্দ সুস্বরে আহ্বান করিতেছে; “নিদ্রাপেক্ষা ধর্ম্মালোচনা অতি উৎকৃষ্ট” আরব্য ভাষায় এ কথার ঘোষণা করিতেছে। ক্রমে সকলেই জাগিয়া উঠিল। নিত্যক্রিয়াদি সমাধা হইবার পর সকলের মুখেই শত সহস্র প্রকারে ঈশ্বরের নাম ঘোষিত হইতে লাগিল। কি বালক, কি বৃদ্ধ, কি যুবক, কি যুবতী, সকলেই ঈশ্বরের গুণগাণ করিয়া বিশ্রামদায়িনী বিভাবরীকে বিদায় দান করিলেন। সকলেই যেন ঈশ্বরের নামে তৎপর, ঈশ্বরের প্রেমে উৎসাহী।

 মদিনাবাসী মাত্রেই ঈশ্বরের উপাসনায় ব্যতিব্যস্ত; কেবল মায়মুনা ঘোর নিদ্রায় অভিভূত। এইমাত্র শয়ন করিয়াছে, উপাসনার সময়ে উঠিতে পারে নাই। নিদ্রাভঙ্গের পরেই তাহাকে যে ভয়ানক পাপকার্য্যে প্রবৃত্ত হইতে হইবে,—যে সাংঘাতিক কার্য্যের অনুষ্ঠান করিতে হইবে, তাহা ভাবিলে হৃদয় কম্পিত হয়। অর্থলোভে পুণ্যাত্মা হাসানের প্রাণবিনাশে হস্ত প্রসারণ করিবে! ওঃ! পাষাণীর প্রাণ কি পাষাণ অপেক্ষাও কঠিন! নিরপরাধে পবিত্র দেহের সংহার করিবে, এ পাপ কি একটুও তাহার মনে হইতেছে না!